সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৫ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
সুজিতের সঙ্গে ছন্দার (ছদ্মনাম) বিয়ে হয়েছে মাত্র দু’মাস হতে চলল। বিয়েটি পারিবারিকভাবে হয়। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ছন্দাকে শশুড় বাড়ির লোকজন ঘরে তুলে নেন। প্রথা অনুযায়ী কয়েকদিন পরেই ছন্দা বাবার বাড়িতে আসে। এরপর আর স্বামীর সংসারে ফিরে না। স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন একাধিকবার ছন্দাকে নিতে তার বাবার বাড়ির দ্বারস্থ হয়। কিন্তু কিছুতেই স্বামীর বাড়িতে ফিরে না ছন্দা। ছেলেটির পরিবারে দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। ছন্দাও স্পষ্ট করে তার স্বামীকে কিছু বলে না। অবশেষে সুজিতের পরিবার সিদ্ধান্ত নেন, একটি আইনগত সমাধান। কিন্তু সেটা কিভাবে?
কারও স্ত্রী যদি আইনগত কোন কারণ ছাড়াই তার স্বামীর সাথে একত্রে বসবাস না করে, সে ক্ষেত্রে স্বামী দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে। তবে পারিবারিক আদালতে যাওয়ার আগে প্রয়োজনে আইনজীবীর মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি একটি নোটিশ পাঠানো যেতে পারে। অপর পক্ষের জবাবের জন্য অপেক্ষাও করা যেতে পারে। যদি কোনো কারণে স্ত্রী সংসার করতে ইচ্ছুক না থাকে, তাহলে আইনি উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোই ভালো।
আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, স্ত্রী সংসার করতে ইচ্ছুক। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় স্ত্রীর বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজন। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০০ ধারা অনুযায়ী তল্লাশি পরোয়ানার মামলা করে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করানো সম্ভব।
অন্যদিকে দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের মামলায় বাদীকে অবশ্যই প্রমান করতে হবে যে, সে নির্দোষ ও নিরীহ মনোভাব নিয়েই আদালতের কাছে বিচার প্রার্থী হয়েছে। স্ত্রী যদি প্রমাণ করতে পারে যে, স্বামী তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, তবে স্বামী ডিক্রি পাবে না। নিষ্ঠুরতার আকার প্রকৃতি এমন হতে হবে যে, ওই অবস্থায় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর ঘরে যাওয়া নিরাপদ নয়, তখন সেটা হবে একটি উত্তম বৈধ প্রতিরক্ষামূলক চুক্তি ।
ীঅনেক সময় দেখা যায়, স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে ঘরে ফেরা সম্ভব নয়। এরকম হলে স্বামী এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আবার স্বামী যদি স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ আনেন, এ যুক্তি সত্য হলে দাম্পত্য অধিকার উদ্ধারে আদালত ডিক্রি জারি করতে পারেন। তবে স্বামী যদি সমাজচ্যুত কোনো কুখ্যাত সন্ত্রাসী বা মাস্তান হন, সে ক্ষেত্রে স্ত্রীর বিরুদ্ধে দাম্পত্য অধিকারের মোকদ্দমা অচল হবে এবং স্ত্রী স্বামীর ঘরে ফিরতে বাধ্য নন।
দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবির ক্ষেত্রে আইনবিদদের মধ্যে রয়েছে দ্বিমত। বিভিন্ন মামলার নজিরেও ভিন্নমত পাওয়া গেছে। এতে অভিযোগ উঠেছে, কেউ যদি স্বাধীনচেতা হন, পূর্ণাঙ্গভাবে আলাদা থাকতে চান এতে সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একতরফা দাবির কোনো সংঘাত হবে কি-না।
১৮ বিএলডি (১৯৯৮)-এ খোদেজা বেগম বনাম মোঃ সাদেক মামলার রায়ে বলা হয়, ‘দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য একটি পারষ্পরিক অধিকার। সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদের সঙ্গে এটি বৈষম্যমূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’
হোসেন জাহান বনাম মো: সাজাহান মামলায় (১৮ বিএলডি, ১৯৯৮) বলা হয়, ‘বিনা কারণে যদি কোনো স্ত্রী দাম্পত্য মিলনে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামী মামলা করতে পারেন।’
আরেকটি মামলার (১৬ বিএলডি, ১৯৯৬ পৃষ্টা ৩৯৬-৩৯৮) লিপিবদ্ধ বর্ণনায় নিম্ন আদালত থেকে স্বামীর পক্ষে ডিক্রি এবং আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে স্ত্রী রিভিশন মামলা করলে হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ (বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বজলুর রহমান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত) এ ডিক্রি বাতিল করেন এবং দাম্পত্য অধিকার মোকদ্দমা ডিস্মিস করেন। ওই রায়ে সৈয়দ আমির আলীর মোহামেডান “ল” গ্রন্থ থেকে বিয়ের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করা হয় এবং বলা হয়-
‘কোনো দেওয়ানি বা ধর্মীয় আইনের চোখে ইসলামী আইন অধিক কঠোর, যা একজন মহিলাকে তাঁর বিবাহিত জীবনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে। ইসলামি আইনে এ অত্যাচার স্বামী কর্তৃক কেবল দৈহিক বা মানসিক অত্যাচার বোঝায় না, স্বামীর সঙ্গে বসবাসে স্ত্রীর অনিচ্ছুকতাও বোঝায়।’
দাম্পত্য পুনরুদ্ধার মোকদ্দমার ক্ষেত্রে স্বামীরা এ প্রতিকার বেশি চাইলেও ৯০ শতাংশ ডিক্রিই স্ত্রীর পক্ষে যায়। আর এ ধরনের প্রতিকার স্বামী বা স্ত্রীকে দাম্পত্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডিক্রি কোনো পক্ষ পেলেও সাধারণত ডিক্রি কার্যকর হয় না। এ ডিক্রি প্রাপ্তির ফলে কেবল স্বামী বা স্ত্রীর উপর দাম্পত্য অধিকারটি স্থাপিত করা যায়, যাতে অপর পক্ষ দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা বিনা কারণে তালাক না চান। তবে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপরে জোর করা যায় না। এতে সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকার লংঘিত হয়। তবে কেউ যদি তালাক চান, তাহলে আলাদাভাবে তা কার্যকর করতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮।