বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
রাজধানী শহর থেকে দূরে প্রচারণা থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে এঞ্জেলা গোমেজ গ্রামের নারীদের বাঁচতে শিখিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির নাম ‘বাঁচতে শেখা’, যার কার্যক্রম মূলত যশোর এলাকায়। এঞ্জেলা গোমেজ যে প্রণোদনা সৃষ্টি করেছেন, তাতে প্রান্তিক ও দুস্থ নারীদের বিশ্বাস জন্মেছে, আর্থিক মুক্তিই হচ্ছে তাদের জীবনের প্রকৃত স্বাধীনতা। মূলত আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে দক্ষতা বৃদ্ধি, কুটিরশিল্প, শস্য উত্পাদন, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ, মৌমাছি পালন, সিল্ক উত্পাদন প্রভৃতি কাজে ব্যাপৃত রেখেছেন ৪০০ গ্রামের নারীদের। এই অনুকরণীয় উদ্যোগের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান ১৯৯৯ সালে। এঞ্জেলা গোমেজ তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন বাঁচতে শেখার মাধ্যমে গ্রামীণ অসহায় নির্যাতিত গরিব নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। কয়েকটি ভাগে এ কাজ করা হয়। মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে নারী উন্নয়নের কাজ ধারাবাহিকভাবে চলছে। জীবন-যাপনের মান উন্নয়ন ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির জন্যে বাঁচতে শেখা বয়স্ক নারীদের শিক্ষা দিয়ে থাকে। এছাড়া যে সব শিশু-কিশোর শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে তাদেরকেও লেখাপড়ার আওতায় আনা হয়। এঞ্জেলা গোমেজ জানান, গরিব অসহায় ও নানা কারণে ঝরে পড়া শিশু-কিশোরদের ‘কিশোর শিক্ষা’ পদ্ধতির আওতায় এনে শিক্ষা দেওয়া হয়। বাঁচতে শেখার এই শিক্ষা অর্জন করে শিশু-কিশোররা লিখতে পড়তে পারে। পাশাপাশি পুষ্টিজ্ঞান, বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে। বাঁচতে শেখার শিক্ষা প্রকল্প থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজার কিশোর শিক্ষা সুবিধা লাভ করেছে। বাঁচতে শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা। গ্রামীণ নারীদের এই স্বাস্থ্য সেবার অধীনে শিশুদের ছয়টি মারাত্মক রোগের টিকা প্রদান করা হয়। এছাড়াও মহিলাদের পুষ্টিজ্ঞান, গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব, প্রসূতি সেবা ছাড়াও জরুরি চিকিত্সা সেবা প্রদান করা স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রকল্পের অন্যতম। মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রকল্প থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ মা ও শিশু উপকৃত হয়েছে। বাঁচতে শেখা হস্তশিল্পে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের আয়মূলক কর্মকাণ্ডকে বিকশিত করেছে। বাংলাদেশের বিলুপ্ত প্রায় ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পকে ফিরিয়ে আনাসহ অবসর সময়ে নারীদের আয়মূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে সংগঠনের সদস্যদের আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ৮টি কেন্দ্রের মাধ্যমে এক বছর মেয়াদি হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাঁচতে শেখা পাঁচ লাখ গ্রামীণ নারীকে সহায়তা করেছে।
এঞ্জেলা গোমেজ বলেন, ‘নারী ক্ষমতায়নের মাধ্যমে আমার ইচ্ছা আছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারকে আলোকিত করব। আমাদের যে রিসোর্স আছে তাকে কাজে লাগাব। আমার কোটি কোটি টাকা থাকলে একটি ওপেন ইউনিভার্সিটি করতাম। যেখানে গ্রাম পর্যায়ের প্রতিটি মানুষ বাস্তবভিত্তিক লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে।’
এঞ্জেলা গোমেজের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় তার মায়ের কাছে। শুরুতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের মঠবাড়ি মিশন স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে। এই স্কুল থেকে এঞ্জেলা পঞ্চম শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়েছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সেই মঠবাড়ি মিশন স্কুলে শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব পান এঞ্জেলা। পরবর্তীতে গ্রাম থেকে ৭/৮ কি.মি. দূরে নাগরী মিশনের ‘পাঞ্জুরা বোর্ডিং স্কুলে’ ফাদারের সহযোগিতায় এঞ্জেলা ক্লাস সিক্সে ভর্তি হন। এই স্কুলে এঞ্জেলা এক বছর পড়েন এবং ক্লাস ফাইভে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পান। এরপর এঞ্জেলা ঢাকা হলিক্রস কলেজের টিচার্স ট্রেনিংয়ের শর্ট কোর্সে ভর্তি হন। এরপর পড়াশোনার এবং বোর্ডিং সুবিধার জন্য ভবেরপাড়া মিশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেখান থেকে আবার যশোরের সেক্রেট হার্ট স্কুলের বোর্ডিংয়ে থাকার ব্যবস্থা হয় এবং অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ এঞ্জেলা সেক্রেট হার্ট স্কুলের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কেজি, নার্সারি শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব পেয়ে এঞ্জেলা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। দিনে ক্লাস নিয়ে রাতে মোম জ্বালিয়ে লেখাপড়া অব্যাহত রাখেন। ১৯৬৮ সালে যশোর শহরের সেবাসংঘ স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭২ সালে যশোর মহিলা কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন। নানা ধরনের প্রতিকূল আর অসহায় অবস্থাতেই তিনি ১৯৭৪ সালে যশোর মহিলা কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হয় এঞ্জেলা গোমেজের কমর্জীবন শুরু। গাজীপুরের মঠবাড়ি মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় ফাদার বার্কম্যান এঞ্জেলাকে একই স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করেন। মাসে ১০ টাকা বেতনে তার দায়িত্ব ছিল শিশুদেরকে পড়ানো। অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার পর এঞ্জেলা যশোর সেক্রেট হার্ট মিশন স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৮১ সালে তার সংগঠন বাঁচতে শেখার যাত্রা শুরু হয়।