শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩২ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: শ্রাবন্তী (ছদ্মনাম) একজন পতিতা, সৎ মায়ের ঘরে বেড়ে ওঠা তার। সংসারে উপার্জনের কোনো লোক নেই। তাই সুন্দর, স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়ে নাম লেখান পতিতাদের তালিকায়। কখনো কখনো রাস্তায়, রেললাইনের পাশে কখনো সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বাসায় কিংবা হোটেলে রাত যাপন করতে হয় নতুন নতুন খদ্দেরের সঙ্গে। আর এর সাথে যুক্ত থাকে কয়েকজন দালাল চক্র। কোনো এক ঘটনায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বাসায়। সেখানে গিয়ে শ্রাবন্তী দেখতে পান একজন পাগলের সাথে সময় দিতে হবে। এটি কি করে সম্ভব? শ্রাবন্তী প্রশ্ন করলে পাগলটির বাবা বলেন তার ছেলেটি একটি মেয়েকে ভালোবাসতো যে আজ তার জীবনে নেই। যত টাকা লাগে সে দিবে কিন্তু তাকে কয়েক মাস তার সাথে থাকতে হবে। এদিকে সুমন নামে একজন শ্রাবন্তীকে ভালোবাসে। শ্রাবন্তী বলতেই সে পাগল। তাইতো সুমন বিয়ের বাজার করে সামনে এসে দাঁড়ায় শ্রাবন্তীর। কি করবে শ্রাবন্তী? পতিতাতের জীবন বৈচিত্র নিয়ে এরকম হাজারো গল্প রয়েছে আমাদের সমাজে।
পতিতাবৃত্তির অপর নামসমূহ গণিকাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি। ইতিহাসের আদিকাল থেকে এদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমন-দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপতœী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজজব্রা, অসোগু, গণিকা, কুলটা, বারণবণিতা, কুম্ভদাসী, নটি, রুপজীবা ইত্যাদি। এ পেশায় নিয়োজিতরা নিজদেহ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ নিজদেহ স্বেচ্ছায় অপরকে ভোগ করার সুযোগদানের বিনিময়ে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন। জর্জ স্কট তার ‘পতিতা বৃত্তির ইতিহাস’ নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-‘পতিতারা হলো সেই সম্প্রদায়ভূক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।’ অক্সফোর্ড ডিকশনারি মতে বেশ্যা হল একজন নারী যে তার দেহ ভাড়া দেয় যথেচ্ছ যৌন-সংসর্গের জন্য।
বাংলা পিডিয়া তথ্য সূত্র মতে মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, একজন বেশ্যা ভাল প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পূনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এই জীবিকা সম্বন্ধে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মান জনক বৃত্তিগুলির মধ্যে পতিতা বৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। বিশিষ্ট প্রতœতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ডঃ অতুল সুর তার দেবলোকের যৌনজীবন বইয়ের ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’। রোমান ইতিহাস মতে, পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তাঁর “কাদম্বরী” গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাত। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিতো। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী কর্তৃক রচিত ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’ শোভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটিতে তিনি লিখেছেন ‘বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের, রক্ষিতা ছিল। এমনকি ঐ রক্ষিতার গর্ভে তাঁর একটি পুত্রও জন্মে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যা পাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন। নিষিদ্ধ পল্লীতে গমনের ফলে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস আক্রান্ত হওয়ার খবর তার জীবদ্দশাতেই ‘বসুমতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। ডা. লুৎফর রহমান তার ‘মহাজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন “এই সমাজে যদি তাদের (গণিকাদের) প্রয়োজন নাই থাকতো তাহলে তারা অনেক আগেই হরিয়ে যেত।” প্রবীর কুমার চট্রোপাধ্যায় রচিত ‘কালিকা পুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ বইয়ের ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত যে, হিন্দুরা মনে করে, বেশ্যারা এই সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দুর্গাপূজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য।
দেহব্যবসা নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা বিরোধী। এ ব্যবসাটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। পৃথিবীর সকল ধর্ম শাস্ত্রে দেহ ব্যবসাকে বড় ধরনের পাপ বলা হয়েছে। দেহব্যবসা জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর বিধায় পৃথিবীর অনেক দেশেই এটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের মূলদ- আইন দ-বিধিতে দেহব্যবসাকে সরাসরি অপরাধ বলা না হলেও এ অপরাধটি গণউৎপাতের অন্তর্ভুক্ত বিধায় এটি দ-বিধির অধীন একটি অপরাধ। তাছাড়া আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতার জন্য হানিকর যে কোন কাজ নিষিদ্ধকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার একটি মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। গণিকাবৃত্তি বিষয়ে আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে গণিকাবৃত্তি নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় বাস্তবতা হলো রাষ্ট্র সেটি নিশ্চিতে এখনও ব্যর্থ।
বেশ্যাবৃত্তি সাধারণভাবে ভারতে বে-আইনী নয়, কিন্তু ব্যবসার জন্য যৌনতার ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দ্য ইমমরাল ট্র্যাফিক অ্যাক্ট ১৯৫৬ রচিত হয়েছে এটি রোধ করার জন্য। এই আইনের উদ্দেশ্য হল নারী ও শিশু পাচার বা যৌনকর্মে লিপ্ত করার জন্য তাদের সংগ্রহ বন্ধ করা, যাতে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনব্যবসার বলি না হতে হয়।
পৃথিবীর যে সকল দেশে পতিতাবৃত্তি বৈধ ব্যবসা হিসেবে স্বীকৃত সে সব দেশে পতিতাদের নিয়মিত নির্ধারিত সময়অন্তে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কোন পতিতার মধ্যে যৌন সংক্রামক জীবাণু বা ব্যাধি পাওয়া গেলে তাকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত হওয়া বা আরোগ্য লাভ না করা পর্যন্ত এ পেশায় পুন ফিরে আসতে দেয়া হয় না। আমাদের সংবিধানে যেহেতু এ ব্যবসাটি নিষিদ্ধ তাই আমাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো সংবিধানে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু ব্যবসাটি চালু আছে সেহেতু এ ব্যবসায় যারা জড়িত তাদের মাধ্যমে যেন কোন যৌনব্যাধি যেমন সিফিলিস, গণেরিয়া প্রভৃতির বিস্তার না ঘটে সে বিষয়ে রাষ্ট্রের সচেষ্ট থাকা উচিত।
আমাদের জনসংখ্যার ৯০ ভাগের অধিক ইসলাম ধর্মাবলম্বী। পৃথিবীর ধর্মমতসমূহের মধ্যে ব্যভিচার, দেহব্যবসা বা যৌনতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান সবচেয়ে কঠোর। একজন ব্যভিচারীর জন্য ইসলামে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে সেটি হলো পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যু কার্যকর। আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও আমাদের দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু নেই। তথাপিও সংবিধানের চেতনার আলোকে পতিতাবৃত্তি নিরোধ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকর উদ্যোগ আবশ্যক।
আইনি দিক থেকে জবরদস্তিমূলক শ্রম এবং ‘পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪(১) অনুচ্ছেদে জবরদস্তিমূলক শ্রম আদায়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর ১৮(২) অনুচ্ছেদে ‘পতিতা’বৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ পাচারের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। আইনটিতে পাচারের জন্য শাস্তি থাকলেও ভিকটিমের পূনর্বাসনের কোনো বিধান নেই। বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বিদেশে পাচার হয়ে গেলে তাকে ফেরত আনার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট বিধানও এতে নেই। আর পাচারের ঘটনাগুলো ঘটে মূলত সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে। আইনটির মূল সমস্যা হলো এতে সংঘবদ্ধ চক্রের কোনো সংজ্ঞা এবং সংঘবদ্ধভাবে পাচারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান নেই। ফলে আইনটি অনেকখানিই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমীর বাংলাপিডিয়ার মধ্যে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, রাষ্ট্র গণিকালয় পতিতাদের কর্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের নাম নিবন্ধন করে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসে সীমাবদ্ধ রাখে। এসব বসতিস্থল সাধারণত বেশ্যা পাড়া বা পতিতালয় নামে সুপরিচিত। পতিতারা তাদের পেশার জন্য হলফনামা দিয়ে অনুমতি গ্রহণ করতে পারে।
ফ্রান্সে পতিতাবৃত্তি আইনসম্মত। কিন্তু সেখানে অপ্রাপ্তবয়স্কদের দিয়ে যৌনকর্ম করানো আইনসম্মত নয়। তাছাড়া যৌনকর্মীদের নিয়ে কেনাবেচাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জার্মানিতে পতিতাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নতুন আইন করেছেন সেদেশের রাজনীতিবিদরা। ওই আইনের অধীনে কোন পতিতা বা দেহপসারিণীর সঙ্গে কনডম ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘ বাংলাদেশ থেকে পতিতাবৃত্তির অবসান হয়েছে।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮