শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০১ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতে বিচার চাইতে গেলেই প্রথমে পুলিশ, ডাক্তারী পরিক্ষা ও সবশেষে আদালতের কাঠগোড়ায় পূণ ধর্ষনের শিকার হতে হয়। আদালতে বিরুদ্ধপক্ষ তার চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে থাকে। ধর্ষিতাকে মানসিকভাবে হেনস্তা করতেই মূলত প্রতিপক্ষ এমনটা করে থাকে। আর আইনও ওই নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ বলে আখ্যায়িত করার অনুমতি দিয়ে রেখেছে প্রতিপক্ষকে। আদালতে এভাবে মান-ইজ্জত নিয়ে ‘টানাহেঁচড়া’ দেখে অনেকেই বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। সওয়াল-জবাবের নামে আইনজীবীর ‘আপত্তিকর জেরা’ এড়াতে অনেক ধর্ষিতা আবার আদালতের দ্বারস্থ হতে চায় না।
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষনের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছেন বলে গন্য হবেন।
ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
আমাদের দ-বিধি আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যদি কোন পুরুষ নিম্নোক্ত পাঁচটি অবস্থার যে কোনটিতে কোন নারীর সাথে যৌন সঙ্গম করে তাহলে সে ধর্ষণ সংঘটন করেছে বলে গণ্য হবেঃ- ১) নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; ২) নারীর সম্মতি ছাড়া; ৩) মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে; ৪) নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে; ৫) নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়। ব্যতিক্রমঃ-১৩ বছরের কম নয় এমন স্ত্রীর সাথে স্বামী যৌন সঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। এখানে কোথাও বলা হয়নি একাধিক বিয়ে হয়েছে বা কুমারীত্ব নেই এমন নারী ধর্ষণ সংজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবেন। এমনকি এই আইন পতিতাদের জন্যও প্রযোজ্য যদি সে তা প্রমাণ করতে পারে।
এবার আসল কথায় আসি। আমার এ লেখাটি মূলতঃ ধর্ষণের শিকার একজন নারী বিচার চাইতে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই আবারও যে জনসমক্ষে ধর্ষণের শিকার হন, সে বিষয়টি তুলে ধরা। আমাদের সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার সুযোগে ধর্ষক সাধারণতঃ ধর্ষিতাকে ‘কুচরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে ঐরূপ প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারীতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। এ দিকটির নেতিবাচক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ভারতের মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ঝঃধঃব ড়ভ চঁহলধন া. এঁৎসরঃ ঝরহময; (১৯৯৬) ২ ঝঈঈ ৩৮৪ মামলায় অভিযুক্তপক্ষ কর্তৃক ধর্ষিতাকে জেরা করার সময় আদালতের দায়িত্ব সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা নিম্নরুপঃ-
“সাক্ষ্য আইনে ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে বিধান যাই থাকুক না কেন, আসামীপক্ষের কিছু কৌসুলি রয়েছেন যারা ধর্ষণের বিস্তারিত সম্পর্কে ধর্ষিতাকে অনবরত প্রশ্ন করার কৌশল গ্রহণ করে থাকেন। ধর্ষণ ঘটনা বিষয়ে ধর্ষিতাকে বারবার বিস্তারিত উত্তর দিতে হচ্ছে সঠিক ঘটনা তুলে ধরতে নয় এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতা পরীক্ষা করতেও নয়, বরং অভিযোগের সাথে তার দেয়া সাক্ষ্যের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা দেখানোর জন্য। ফলে আসামিপক্ষ কর্তৃক ধর্ষিতাকে জেরা করার সময়ে আদালত নিরব দর্শকের মত বসে থাকা উচিত নয়। অবশ্যই কার্যকরভাবে সাক্ষ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অভিযোগকারীর সত্যনিষ্ঠা এবং তার সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা জেরা করার মাধ্যমে যাচাই করার জন্য অভিযুক্তকে যেমন স্বাধীনতা দেয়া উচিত, তেমনিভাবে আদালতকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ধর্ষিতাকে হয়রানি বা অবমানিত করার জন্য জেরা করা হচ্ছে কি-না। স্মরণ রাখতে হবে, ধর্ষণের শিকার নারী ইতোমধ্যে দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এবং তাকে যদি ঐ অপরিচিত ঘটনার শিকার হওয়া নিয়ে পুনরাবৃত্তি করতে হয় তাহলে সে লজ্জায় নির্বাক হয়ে থাকতে পারেন এবং তার নিরবতাকে ভুল করে সাক্ষ্যের ‘অমিল এবং স্ববিরোধ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকতে পারে।”
তবে আমাদের সাক্ষ্য আইন ধর্ষিতা ও তার সাক্ষীকে আপত্তিকর, অনভিপ্রেত, অশোভন, লজ্জাজনক, আক্রমণাত্মক ও বিরক্তিকর প্রশ্ন করা হতে সুরক্ষা প্রদান করেছে। সাক্ষ্য আইনের ১৫১ ও ১৫২ ধারা পাঠ করলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। সাক্ষী যাতে ভয় বা লজ্জা না পেয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে, সেজন্য নির্দিষ্ট কোন মামলার প্রয়োজনে আদালত বিচার কার্যক্রম রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠান করতে পারেন। এখানে ধর্ষিতা জেরার বিরুপ কোন প্রশ্ন থাকলে তা সহজেই উত্তর দিতে পারবেন। কিন্তু জনাকীর্ণ আদালতে ধর্র্ষিতার পক্ষে সে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া সম্ভব নাও হতে পারে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা ২০ (৬) মতে, কোন ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে কিংবা ট্রাইব্যুনাল স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করলে এই আইনের ধারা ৯ এর অধীন এর বিচার কার্যক্রম রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠান করতে পাররে।
সাক্ষ্য আইনে ইন্ডিয়া যেরুপ সংশোধন এনেছে, সেরুপ আমাদের দেশের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ এর উপধারা ৪ বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত। এই ধারাটি আদালতের কাজে এলেও বর্তমানে ধর্ষিতার ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাকীর্ণ আদালতে ধর্ষিতাকে হেনস্তা করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এই আইনকে। একজন ধর্ষিতা আদালতে বিচার চাইতে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবারও ধর্ষণের শিকার হন। কারণ এ ধারা প্রয়োগ করলে ধর্ষিতার অতীত যৌনজীবন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় একটি বিষয়। প্রতিপক্ষের আইনজীবী বার বার প্রমাণের চেষ্টা করেন আসলে ধর্ষিতা এ রকমের যৌনসম্পর্কে অভ্যস্ত। খোদ একটি আইনের ধারাই যেখানে ধর্ষিতাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে সেখানে ওই ধর্ষিতাকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কোনভাবেই রক্ষা করতে পারবে না। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এই দেশে আছে।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলোতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে কতটা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ফলাফলগুলো কী ছিল তা একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র মামলা, যা ১৩ বিএলসি ২০০৮ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তার শিশুসহ তার কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারিণীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌনসম্পর্কের ইতিহাসকে তার ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় ‘ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন।’
রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য যা ২৮ বিএলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন) ২০০৮ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দুবার বিয়ে হয়েছিল। তাকে তার নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল এবং এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উল্লিখিত কারণে বাদিনীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।’
শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় যা ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে, আদালত অভিযোগকারিণীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তার ‘খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র’ হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তার সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারিণী ছিলেন একজন অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তার নিয়োগকর্তার হাতে ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযোগকারিণী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে প্রবেশ করেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদিনী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তার দেয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে।
ধর্ষণ মামলায় ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে অভিযুক্তের পক্ষ থেকে দেয়া সাক্ষ্য কতটুকু গ্রহণ করা যাবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইন্ডিয়ান ল’ কমিশনের ৮৪ তম রিপোর্টে (১৯৮০) বলা হয়েছে, ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টি লিগ্যাল সিস্টেম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ এবং আইনি-কার্যধারা হতে অনীহা অনুভব করার অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান যা ২৫ বিএলডি (এডি) ২০০৫) মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, ‘বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’
State of U.P. Vs. Pappu @Yunus & anr. AIR 2005 SC 1248 ১২৪৮, মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট বলেন যে, যদি দেখানোও হয় যে মেয়েটি যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত, অভিযুক্ত ব্যক্তি ধর্ষণের দায় হতে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য এটা কোন যুক্তি হতে পারে না। এটা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে, ঐ নির্দিষ্ট ঘটনায় মেয়েটির সম্মতি ছিল। তাছাড়া, ধর্ষিতার শরীরে আঘাতের অনুপস্থিতিই অভিযুক্ত ব্যক্তির অব্যাহতি পাওয়ার কারণ হতে পারে না।
Indian Evidence Act, , ১৮৭২ এর নতুন সংযোজিত ধারা ৫৩ এর বিধান মতে, যৌন হয়রানি, বিবস্ত্র করা বা চেষ্টা করার জন্য বল প্রয়োগ, গোপন যৌন ক্রিয়া অবলোকন, যোগাযোগের গোপন চেষ্টা ও শান্তি নষ্ট, যৌন আঘাত, যৌন আঘাত করে মৃত্য বা বোধশক্তিহীন করা, সেপারেশন সময়ে স্ত্রীকে যৌন আঘাত, বিশ্বস্তার ব্যক্তি, সরকারি কর্মচারি, জেল বা রিমান্ড হোমে যৌন সঙ্গম, একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক একত্রে যৌন আঘাত, কৃত অপরাধের পুনরাবৃত্তি বা এগুলোর চেষ্টা সংক্রান্ত মামলায় ভিক্টিমের সম্মতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে, সেক্ষত্রে ভিক্টিমের চরিত্র বা অতীত যৌন অভিজ্ঞতা বিষয়ে কোন সাক্ষ্য প্রাসঙ্গিক হবে না। ধারা ১৪৬ তে নতুন সংযোজিত অনুশর্তের বিধান মতে, যৌন আঘাত, যৌন আঘাত করে মৃত্য বা বোধশক্তিহীন করা, সেপারেশন সময়ে স্ত্রীকে যৌন আঘাত, বিশ্বস্তার ব্যক্তি, সরকারি কর্মচারি, জেল বা রিমান্ড হোমে যৌন সঙ্গম করে বা এগুলোর চেষ্টা সংক্রান্ত মামলায় ভিক্টিমের সম্মতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে, সেক্ষত্রে ভিক্টিমের সাধারণ অনৈতিক চারিত্র বিষয়ে বা অতীত যৌন অভিজ্ঞতা নিয়ে সাক্ষ্য দেয়া এবং ভিক্টিমকে জেরা করা যাবে না।
উল্লিখিত মামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে এটার মধ্যে যথেষ্ট ঔপনিবেশিক আচরণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কাজেই সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কার্যপ্রক্রিয়াটি স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। আমাদের প্রতিষ্ঠিত আইনী নীতি যে, যদি ধর্ষিতা খারাপ চরিত্রের অধিকারীও হয়ে থাকেন এবং এমনকি যদি বেশ্যাও হয়ে থাকেন, তার গোপনতার অধিকার কোন ব্যক্তি কর্তৃক খর্ব হতে পারে না এবং নির্যাতিতার চরিত্র নির্বিশেষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই ধর্ষণ অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হয়। পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কাজেই আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৮৭২ এর ধারা ১৫৫ এর উপধারা ৪ এর বিধান বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় কি?
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮