মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৮ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ! নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের থেকেই ভিসি নিয়োগের অনুরোধ ইবি শিক্ষকদের সংবিধান সংস্কারঃ সংশোধন না-কি পুনর্লিখন?  সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতাঃ আইন কি বলে?
নির্যাতনে আসামির স্বীকারোক্তি আদায়ে আইনগত ভিত্তি নেই

নির্যাতনে আসামির স্বীকারোক্তি আদায়ে আইনগত ভিত্তি নেই

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সাথে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যেকোন একটির কোন রকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স বলেছেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দূরাবস্থায় উপরোক্ত দু’টি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য।

একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই। জাতিসংঘের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা যোগ দেন। তার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর বৃটেনের একজন করে পুলিশ কর্মকর্তাও যোগ দেন। তাদের প্রশিক্ষনের একটি অংশ ছিল আমাজান বনে। এ বনের মধ্যে কয়েকটি হরিণের বাচ্চা ছেড়ে দেয়া হয়। কর্মকর্তাদের বলা হয় যে, এ বাচ্চা গুলোকে খুঁজে বের করে আনতে হবে। সময় দেয়া হবে একদিন। তবে এর বেশী সময় লাগলেও হরিণের বাচ্চা ছাড়া খালি হাতে ফেরা যাবেনা। সুইজারল্যান্ডের পুলিশ কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হরিণের বাচ্চা উদ্ধার করে ফিরলেন। ফ্রান্সের পুলিশ হরিণের বাচ্চা নিয়ে হাজির হন তিন দিন পর। বৃটেনের কর্মকর্তা সাত দিন পর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ১৫ দিন পর। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশের কর্মকর্তার কোন খোঁজ নেই। প্রশিক্ষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। একমাস পর ব্রজিলের বিভিন্ন শহর থেকে ঘুরে ফিরে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশী পুলিশ কর্মকর্তা। প্রশিক্ষকরা প্রশ্ন করলেন, ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আসলেন কেন? জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কে বলেছে এটা ছাগলের বাচ্চা। একে রিমান্ডে দেন। দেখবেন পরদিন এটা নিজেই স্বীকার করবে যে সে একটা হরিণের বাচ্চা।

দোষ স্বীকারোক্তি বলতে অপরাধকারী কর্তৃক স্বেচ্ছায় প্রণোদিতভাবে নিজের অপরাধের স্বীকার করাকে বোঝায়। দেশে প্রচলিত কোনো আইন দ্বারা যে কর্মকে দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এরূপ অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি যদি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে অপরাধ সংঘটন সম্পর্কে বিনা প্ররোচনায়, কোনোরূপ প্রলোভন ছাড়া নির্ভয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্বেচ্ছায় সত্য বক্তব্য পেশ করেন তাকে স্বীকারোক্তি বলে।

স্বীকারোক্তি লিখে রাখার সময় ম্যাজিস্ট্রেটকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে এটা স্বেচ্ছামূলক। শুধু অপরাধীর বক্তব্যই নয় বরং তার আচরণের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। দোষ স্বীকারোক্তি লেখার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা, ৩৬৪ ধারা, সাক্ষ্য আইনের ২৪ থেকে ৩০ ধারা ও হাইকোর্ট জেনারেল রুলস অ্যান্ড সার্কুলার অর্ডারসের (ক্রিমিনাল) ২৩ ও ২৪ নং রুলস প্রযোজ্য। এ বিধানগুলোর মধ্যে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায়ই দোষ স্বীকারোক্তি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আছে। স্বীকারোক্তি লেখার শেষে স্বীকারোক্তির নিম্নে তিনি একটি প্রত্যয়নপত্র দেবেন।

“আমি (নাম) এর নিকট ব্যাখ্যা করেছি যে, তিনি স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য নন এবং যদি তিনি স্বীকারোক্তি করেন, তাহলে উক্ত স্বীকারোক্তি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, এ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে দেয়া হয়েছে। এ স্বীকারোক্তি আমার উপস্থিতিতে এবং আমার শ্রুতি গোচরে গৃহীত হয়েছে। এটা স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তিকে পড়ে শোনানো হয়েছে এবং তিনি তা সঠিক বলে স্বীকার করেছেন এবং এ লিখিত স্বীকারোক্তিতে তার প্রদত্ত বিবৃতির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বিবরণ রয়েছে।”

আসামির স্বীকারোক্তি রেকর্ডের ক্ষেত্রে তার শপথ গ্রহণের কোনো আইনগত বিধান নেই। কোনো অপরাধজনক ঘটনার পুলিশি তদন্ত চলাকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট স্বীকারোক্তির জন্য নিয়ে আসলে বা উক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট আসলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে ওই ব্যক্তিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানবেন উক্ত ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য ইচ্ছুক কি-না? পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হলে অভিযুক্তকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে কখন, কোথায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং কোথা থেকে সে পুলিশের হেফাজতে আছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যদি ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন ওই ব্যক্তি স্বীকারোক্তি প্রদান করতে আগ্রহী তাহলে তাকে এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার জন্য যুক্তিযুক্ত সময় প্রদান করবেন। সাধারণত ন্যূনতম তিন ঘণ্টা সময় দেয়ার প্রচলন রয়েছে। এ সময়ে উক্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবেন। এ সময় উক্ত ব্যক্তিকে পুলিশের সঙ্গে বা অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ বা পরামর্শ করার সুযোগ দেয়া যাবে না এবং এ সময়ে তিনি যাতে কারো দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত না হতে পারেন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যুক্তিযুক্ত সময় শেষে উক্ত ব্যক্তি যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে বিবেকের তাড়নায় পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হয়েও স্বীকারোক্তি করছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন করবেন এবং তার উত্তর লিখে রাখবেন। এরপর ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৪ ধারা অনুসরণে উক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি লিখে তা তাকে পড়ে শোনাবেন। পড়ে শোনানোর পর উক্ত ব্যক্তি তা সঠিকভাবে লেখা হয়েছে বলে স্বীকার করলে তাতে তার স্বাক্ষর নেবেন এবং ১৬৪ ধারার বিধান মতে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তাতে স্বাক্ষর করবেন। লিখিত স্বীকারোক্তি পড়ে শোনানোর পর যদি স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তি তাতে কোনো সংশোধনের কথা বলেন তবে তা সেভাবে সংশোধন করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য, স্বীকারোক্তি প্রদানকালীন সময়ের যে কোনো পর্যায়ে স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেয়ার ব্যাপারে মনোভাব পরিবর্তন করে স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানালে উক্ত স্বীকারোক্তি আর লেখা যাবে না বা স্বীকারোক্তি দিতে তাকে আর বাধ্য করা যাবে না। এমনকি স্বীকারোক্তি লেখার পরও যদি উক্ত ব্যক্তি তাতে স্বাক্ষর করতে রাজি না হন তবে তাকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা যাবে না এবং এ ক্ষেত্রে তার এটি স্বীকারোক্তি হিসেবেও গণ্য করা যাবে না।

সুতরাং হেফাজতের তোড়ে কোনো আসামি যেসব স্বীকারোক্তি দেয় সেগুলোর আইনগত ভিত্তি নেই। আদালতে সেগুলো সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে এ ধরনের স্বীকারোক্তির অর্থ কী? অর্থাৎ নির্যাতনই সার কথা। দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকেও না জানার কথা নয় হেফাজতকালে পুলিশ গ্রেফতারকৃতকে কী করে, তার সঙ্গে কী আচরণ করে। পুলিশী হেফাজতের প্রায়ই মানুষ মরছে। মৃত্যুগুলোর খবর নিশ্চয়ই প্রজা থেকে রাজারা জানছেন।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘পুলিশের হেফাজতে আর একটি মৃত্যুও নয়।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

 

 

 

 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel