শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৫ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষনের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছেন বলে গন্য হবেন।
ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলা, যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
আমার এ লেখাটি মূলতঃ ধর্ষণের শিকার একজন নারী বিচার চাইতে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই আবারও যে জনসমক্ষে ধর্ষণের শিকার হন, সে বিষয়টি তুলে ধরা। আমাদের সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার সুযোগে ধর্ষক সাধারণতঃ ধর্ষিতাকে ‘কুচরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে ঐরূপ প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারীতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
সেকারণ আমাদের দেশের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ এর উপধারা ৪ বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত। এই ধারাটি আদালতের কাজে এলেও বর্তমানে ধর্ষিতার ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাকীর্ণ আদালতে ধর্ষিতাকে হেনস্তা করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এই আইনকে। একজন ধর্ষিতা আদালতে বিচার চাইতে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবারও ধর্ষণের শিকার হন। কারণ এ ধারা প্রয়োগ করলে ধর্ষিতার অতীত যৌনজীবন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় একটি বিষয়। প্রতিপক্ষের আইনজীবী বার বার প্রমাণের চেষ্টা করেন আসলে ধর্ষিতা এ রকমের যৌনসম্পর্কে অভ্যস্ত। খোদ একটি আইনের ধারাই যেখানে ধর্ষিতাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে সেখানে ওই ধর্ষিতাকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কোনভাবেই রক্ষা করতে পারবে না। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও আমাদের দেশে আছে।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলোতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে কতটা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ফলাফলগুলো কী ছিল তা একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র মামলা, যা ১৩ বিএলসি ২০০৮ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তার শিশুসহ তার কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারিণীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌনসম্পর্কের ইতিহাসকে তার ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় ‘ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন।’
শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় যা ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে, আদালত অভিযোগকারিণীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তার ‘খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র’ হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তার সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারিণী ছিলেন একজন অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তার নিয়োগকর্তার হাতে ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযোগকারিণী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে প্রবেশ করেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদিনী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তার দেয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে।
অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান যা ২৫ বিএলডি (এডি) ২০০৫) মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, ‘বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’
উল্লিখিত মামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে এটার মধ্যে যথেষ্ট ঔপনিবেশিক আচরণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কাজেই সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কার্যপ্রক্রিয়াটি স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। আমাদের প্রতিষ্ঠিত আইনী নীতি যে, যদি ধর্ষিতা খারাপ চরিত্রের অধিকারীও হয়ে থাকেন এবং এমনকি যদি বেশ্যাও হয়ে থাকেন, তার গোপনতার অধিকার কোন ব্যক্তি কর্তৃক খর্ব হতে পারে না এবং নির্যাতিতার চরিত্র নির্বিশেষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই ধর্ষণ অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হয়। পৃথিবীতে এমন কোন সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে ‘আইন’ ধারনাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারীতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময় উপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কাজেই আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৮৭২ এর ধারা ১৫৫ এর উপধারা ৪ এর বিধান বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় কি?
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা। Email:seraj.pramanik@gmail.com মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮