শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৪ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষিকা নাসরিন আক্তার (ছদ্মনাম)। স্বামী বিদেশে থাকার সুযোগে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রহমত আলীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেন। চেয়ারম্যান বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ওই শিক্ষিকার প্রবাসী স্বামীকে তালাক দিতে বাধ্য করেন। তালাক পরবর্তী চেয়ারম্যান নিজের সাজানো এক কাজী অফিসে গিয়ে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ ঘটনার কিছু দিন পর ওই চেয়ারম্যান শিক্ষিকাকে না জানিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। এর প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান ওই শিক্ষিকাকে স্ত্রী হিসেবে অস্বীকার করেন এবং জানান, ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে তিনি তাকে বিয়ে করেছিলেন।
অসহায় শিক্ষিকা বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। আমাদের আলোচনা বিষয় হচ্ছে যে, দেশের বিদ্যমান আইন অনুসারে ‘ধর্ষণ’ সংঘটিত হয়েছে কি-না। এই ঘটনাগুলোর সূচনা হয়েছে প্রেম-ভালবাসার মাধ্যমে; যেখানে সম্পর্কের একটা পর্যায়ে গিয়ে প্রেমিক পুরুষটি সঙ্গী নারীটিকে বিয়ের প্রলোভন বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করছে। পরে পুরুষটি যখন তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না, ঠিক তখনই নারীটির তরফ থেকে আদালতে গিয়ে ‘ধর্ষণের’ মামলা ঠুকে দিচ্ছে।
এখন আমাদের দেখার বিষয় হচ্ছে এই যে, প্রচলিত আইনে এ ধরনের সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যায় কি-না। ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। তবে যদি ১৬ বছরের অধিক হয় তা হলে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি থাকলে তাকে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না এবং যৌনকর্মের সঙ্গীকেও দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া যাবে না।
প্রথম তিনটি দৃশ্যপটে যে ঘটনাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে কি-না? এই প্রশ্ন উঠছে এই কারণে যে, এর কোনোটিতেই নারীটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিংবা অমতে, বলপ্রয়োগে বা ভীতিপ্রদর্শন করে কিংবা ‘বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে’ এই মর্মে শঠতা করে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করা হয়নি। সুতরাং এখানে ‘প্রতারণা’র অস্তিত্ব থাকলেও, আমাদের বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের যে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে, তার আওতায় একে আনা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিমকোর্টে একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলের সঙ্গে পরিণয় থাকা অবস্থায় শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় এবং তখন যদি সে এ বিষয়ে আপত্তি না দেয় তাহলে সম্পর্ক চুকিয়ে যাওয়ার পর বিগত দিনের ঘটনার জন্য ধর্ষণের কোনো অভিযোগ আনা যাবে না। এ ছাড়া বিচারপতি বিক্রমজিৎ সেন ও বিচারপতি এসকে সিংয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ মেয়েদের ব্যর্থ সম্পর্কের পরিণতিতে এবং বিয়ের প্রলোভনের ভিত্তিতে দায়ের করা ধর্ষণ মামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিষয়টি ধর্ষণ হবে কি-না, সে বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন ‘বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের মতো নৈতিক স্খলনকে কি ধর্ষণ বলা যায়, যখন নারীটি খোলা চোখে পুরুষটির সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন?’ আদালত তার সিদ্ধান্তে বিষয়টি দেখিয়েছেন এভাবে ‘এটি ভালোবাসা নয়, বোকামি’।
২০১৩ সালের ‘দীপক গুলাতি বনাম হরিয়ানা রাজ্য’ মামলায় বিচারপতি বিএস চৌহান ও বিচারপতি দীপক মিশ্র এ বিষয়ে আসামির পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন এবং মন্তব্যে বলেন, ‘যখন ছেলে-মেয়ের মধ্যে গভীর ভালোবাসা থাকে তখন তারা অনেক সময় একাধিকবার এবং পুনঃপুনঃ একে অন্যকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে; যার ফলে ওই প্রতিশ্রুতি তার গুরুত্ব হারায়। অর্থাৎ ছেলে কর্তৃক ওই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে মেয়ে যদি তার সর্বস্ব সজ্ঞানে ভয়ভীতি ছাড়া ওই ছেলেকে দেহ দান করে, সে ক্ষেত্রে পরে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর কোনো পক্ষের আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়; অর্থাৎ ধর্ষণের মামলা এখানে অচল।’
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
মোটকথা, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যখন জেনে-বুঝে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেন তখন পরবর্তীতে সেই সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে আদালতের কাছে প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের দায়ে প্রতারণার মামলা চলতে পারে। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে। কারণ এই বয়সী মেয়ে সম্মতি দেয়ার মতো সক্ষমতা রাখে না বলে আইন মনে করে। কেবল প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ানোর আগে নারীদের অত্যন্ত সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা। মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮