শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৫ অপরাহ্ন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ১০ কিঃমিঃ দূরে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত সবুজ-শ্যামল ছায়া সুশীতল একটি গ্রাম। ঠাকুর পরিবারের এই বাড়িটি সবার কাছে শিলাইদহের কুঠিবাড়ী নামেই পরিচিত। আসলে কুঠিবাড়িটি রবীন্দ্রনাথ নিজে তৈরী করেননি, এটি ছিল নীলকর ইংরেজ সাহেবদের। পরে জমিদারি চালানোর সুবিধার্থে ঠাকুর পরিবার বাড়িটি কিনে নেয়।
বাড়িটি এখন বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুজ হয়ে পড়লেও চাকচিক্য আছে দেখার মতো। পুরো বাড়িটা আমবাগানে ঘেরা। বাড়ির চারপাশে ঢেউ খেলানো দেয়াল, যেন পদ্মারই ঢেউ। পাশে বকুল তলার শানবাঁধানো পুকুর ঘাট, জায়গাটা এখনো কোলাহলপূর্ণ। বাড়ির সামনে শান-বাঁধানো উন্মুক্ত বৈঠকখানা যেখানে প্রজারা এসে বসতো সেই সময়। বাড়ির পেছনে টেনিস কোর্ট। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে বড় বড় কয়েকটি কক্ষ, সোফাসজ্জিত ড্রইংরুম। পড়াশোনার টেবিল, চেয়ার, শোবার ঘর বিছানো খাট, বড় আলমারী, বুকসেলফ, আরাম কেদারা, স্নানের চৌবাচ্চা, বিশালাকার কমোড বিশিষ্ট বাথরুম। জানালা খুললে উপনের দুই বিঘা জমি, সেই তাল গাছের স্থান। উত্তর থেকে দক্ষিণ দিক পর্যন্ত প্রশস্ত কাঠের ঝুলবারান্দা, সামনে চওড়া বারান্দায় আছে একটি বড় ¯িপ্রডবোর্ড, তিনতলার ছাদে উঠলে চোখে পড়ে পদ্মার চর, কখনোবা ঢেউয়ের খেলা। শুধু যা নেই তা হল কবির পদচারণা, কোলাহলমূখর সেইসব অতীত।
পদ্মা-গড়াই-হিশনার শীতল স্রোতে প্লাবিত এই অঞ্চল। এখানকার জনপদের ইতিহাস এক নদীর মতোই উদার, মহান ও বিশালতাই পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেছিলেন প্রথমে জমিদারী দেখাশোনা করার কাজে। জমিদার রবীন্দ্রনাথ মিশে গিয়েছিলেন শিলাইদহের প্রতিটি মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে। তার প্রতিটি লেখায় মুর্ত হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের কথা। হয়তো শিলাইদহের অকৃত্রিমতাই মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়ে উঠেছিলেন আকাশ ভরা সূর্যতারা/ বিশ্ব ভরা প্রাণ/ তাহারি মাঝখানে, আমি পেয়েছি মোর স্থান/ বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥ শুধু জমিদারিত্বই নয় এই শিলাইদহ ছিল রবী ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির এক অপূর্ব প্রেরণা। এখানে তিনি রচনা করেন মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, বলাকা, ক্ষণিকা, নৈবদ্য প্রভৃতি। তার অনবদ্য সৃষ্টি গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্প রচিত হয়েছিল এখানেই এমনকি গীতাঞ্জলীর অধিকাংশ গল্প। এমনকি গীতাঞ্জলীর অধিকাংশ গান সৃষ্টি হয় এই শিলাইদহে। ১৮৯০ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত রীবন্দ্রনাথ বিচরণ করেছেন শিলাইদহে। জমিদারির কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে কখনও স্বল্প কখনও দীর্ঘ সময় থেকেছেন এখানেই। এসেছেন একাকী কিংবা স্বপরিবারে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বোর্ডে, পালকিতে। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথকে শিলাইদহ কতখানি সমৃদ্ধ করেছিল তার লেখাতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্প-সাহিত্য, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এখানে সে সময় আবির্ভাব ঘটেছিল বড় বড় প্রভাবশালী মহৎ সব ব্যক্তিত্বের। তাই তিনি আবেগ ভরা কন্ঠে বলেছিলেন ….ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী আমারই সোনার ধানে গিয়াছে যে ভরি। রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশাতে ১৩৪৬ সালের ১ চৈত্র শিলাইদহ পল্লী সাহিত্য সম্মেলনে সম্পাদককে লিখেছিলেন আমার যৌবন ও প্রৌঢ় বয়সের সাহিত্যরস সাধনার তীর্থস্থান ছিল পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহের পল্লীতে। এক সময়ের কোলাহলপূর্ণ সেই বাড়িটি এখন এক স্মৃতিচিহ্ন জাদুঘর। মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে মানুষ পেতে পারে অতীতের সেই সোনালী স্পর্শ। এখানে আছে কবির আঁকা ছবি ও লেখা। এছাড়াও আছে কবি ব্যবহৃত পালকি, ছয় বেহারার পালকি, চার বেহারার পালকি। আছে বিট্রিশ আমলের ঘাস কাটার যন্ত্র, কিছু দূর্লভ পেপার কাটিং ও কবির নিজ হাতে লেখা চিঠি। মূল বাড়ির বাইরে একটি বিশাল আকার মঞ্চ আছে।
প্রতি বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী (২৫ বৈশাখ) এখানে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। দেশ-বিদেশ থেকে রবীন্দ্র ভক্তরা যোগ দেয় এ অনুষ্ঠানে। ২৫ বৈশাখ উপলক্ষে এখানে বসে তিন দিনের মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করে লোক সমাগম হয় প্রচুর। সবর হয়ে ওঠে কুঠি বাড়ি।
বাড়িটার উচ্চতা আড়াইতলা। অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে তৈরি বাড়িটার প্রকৃত সৌন্দর্য বলতে হলে বোধহয় বিশ্বকবির মতো কবিতাতেই বলতে হবে। কেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মিসরের পিরামিড নিয়েই তো অসাধারণ একটি উক্তি করেছিলেন, এখানে পাথরের ভাষা মানুষের ভাষাকে অতিক্রম করিয়াছে। স্বয়ং কবিগুরুর এই অসাধারণ উক্তিটি তার কুঠিবাড়ি সম্পর্কেও অবলীলায় চালিয়ে দেয়া যায়। তবে পিরামিডের পাথরের স্থলে এখানে বসাতে হবে ইটের কথা। কবিগুরু সম্ভবত গাছগাছালি খুবই ভালবাসতেন। ভালবাসবেনইবা না কেন? প্রকৃতির মতো মনটাও যে সবুজ না হলে তো আর কবি হওয়া যায় না। তার ওপর বিশ্বকবি। সে কারণেই বাড়িটার চারধারে পশ্চিম-পূর্ব-উত্তর কোণে রবীন্দ্রবয়সী কিছু গাছের ছায়া রয়েছে। বাড়িটার পেছন দিকটায় যে সুবৃহৎ বয়স্ক কাঁঠাল গাছ এখনও বর্তমান সেগুলোর অনেক ডালপালা রবীন্দ্রনাথের এ বাড়িটিতে চলা-ফেরার সাক্ষী। মনুষ্য স্বরধ্বনি পেলে হয়তো সত্যি সত্যিই তাদের কাছ থেকে কবিগুরু সম্পর্কে অজানা অনেক কিছুই জানা যেত।
পূর্ব দিকে একসাড়িতে দাঁড়ানো চারটা তালগাছ। তিনটা একত্রিত, একটু দূরে একটি তালগাছ একদম একা। প্রিয় ছড়াটি হয়ত কবি এই গাছগুলোর কোনও একটি দেখেই লিখেছিলেন তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে—। দুই বিঘা জমির ওপর চোখ জুড়ানো ও মনকাড়া অপরূপ দক্ষিণমুখী এ বাড়ির চারপাশে রয়েছে পদ্মার ঢেউ খেলানো বাউন্ডারি প্রাচীর। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮৩০ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী জেলার পতিসর ও পাবনার শাহজাদপুর নামক স্থানের জমিদারির মালিকানা পান। এসব জমিদারির কেন্দ্রস্থল ছিল শিলাইদহ। জমিদারি কাজ তদারকি করার উদ্দেশ্যেই কবির ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথসহ অন্যরা কুষ্টিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোমুগ্ধকর রূপ দর্শনে আগমন করেছেন শিলাইদহে। কবিগুরু শিলাইদহে প্রথম এসেছিলেন ১৮৭৬ সালে, পরবর্তী সময়ে ১৮৯২ জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে। শিলাইদহে কুঠিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু শিলাইদহের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবির কাছে এতই ভালো লেগেছিল যে, কবি মুগ্ধ হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। পদ্মা নদীর প্রতি কবির দুর্বার আকর্ষণ ছিল।
এ শিলাইদহে ঠাকুর বংশের প্রায় সবই পল্ল¬ীভবনে বাস করে পদ্মা, গড়াই বিধৌত পল্ল¬ী প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। ১৮৯২ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। ১৯৫৮ সাল থেকে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের ব্যবস্থাপনায় শিলাইদহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িটি গৌরবময় স্মৃতিরূপে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুঠিবাড়ির গুরুত্ব অনুধাবন করে কবির বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংগ্রহপূর্বক একে একটি জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজিতে ভরপুর এ রবীন্দ্র লীলানিকেতন। চিলাকোঠা স্থাপত্যে মূল ভবন ২ বিঘা জমির ওপর পদ্মার ঢেউ সাদৃশ্য বেষ্টনী প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত কুঠির ছাদের কার্নিশেও সেই একই ছাপ। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় ৮টি করে ১৬টি এবং তিন তলায় ২টি, মোট ১৮টি কক্ষ রয়েছে। তিন তলায় ছিল কবির লেখার ঘর। এ ঘরে বসে কবি লিখেছেন অনেক কবিতা ও গল্প। উত্তরে পদ্মা, দক্ষিণে গড়াইয়ের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কবিপ্রতিভার যে দৃষ্টিদায়িনী ছিল তা এখান থেকে বোঝা যায়। দেশী-বিদেশী ফুলের সাদৃশ্য বাগান কবিভবনটি আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
পুরো ভবনটি এখন জাদুঘর হিসেবে দর্শকদের জন্য উš§ুক্ত। জাদুঘরের নিচ ও দ্বিতীয় তলায় ১৬টি কক্ষেই কবি রবীন্দ্রনাথ, শিল্পী রবীন্দ্রনাথ, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, কৃষক বন্ধু রবীন্দ্রনাথÑ অর্থাৎ নানা বয়সের বিচিত্র ভঙ্গির রবীন্দ্রনাথের ছবি। বাল্যকাল থেকে মৃত্যুশয্যার ছবি পর্যন্ত সংরক্ষিত রয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে শিল্পকর্ম এবং তার ব্যবহার্য আসবাবপত্র দিয়ে পরিপাটিভাবে সাজানো। তিনতলায় রয়েছে কবির ব্যবহƒত আসবাবপত্র। এছাড়াও রয়েছে কবির নিজ হাতে লেখা কবিতা, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর প্রকাশিত কবির ছবি ও সনদপত্র। কবিভবনে ব্যবহার্য জিনিসগুলোর মধ্যে আরও আছে চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটো স্পিডবোট, পন্টুন, ৮ বেহারা ও ১৬ বেহারা পালকি, কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, সোফা সেট, আরাম চেয়ার, হাত পালকি, গদি চেয়ার, পালংক, চীনা মাটির তৈরি ওয়াটার ফিল্টারসহ অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস। এছাড়াও রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও বিভিন্ন মনীষীর গ্রুপ ছবি এবং কবির আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম। রক্ষক কাম গাইড শাজাহান আলী অনেক সাহায্য করেছিলেন কবি ও কবিবাড়ি সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে। কেবল আমাদেরই নয়, কুঠিবাড়িতে প্রতিদিন সকাল বিকালে আগত অজস্র দর্শনার্থীকে কুঠিবাড়ির ভেতরকার রবিঠাকুরের ব্যবহƒত আসবাবপত্র, কবির কর্মকা-, শিলাইদহে অবস্থান করে কবির সৃষ্টি সম্পর্কিত ইত্যাকার বিষয়ে বরাবর তিনিই সবাইকে তথ্য দিয়ে থাকেন।
লেখকঃ গবেষক ও আইনজীবী