শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৮ অপরাহ্ন
এস.এম. জামাল খান : নিজ কন্যার বিয়েতে যত আয়োজন, এ বিয়েতেও আয়োজনের কোন কমতি ছিল না। ডিসি নিজেই তিন কন্যার বিয়ের দায়িত্ব নিলেন। কন্যারা থাকেন কুষ্টিয়া সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। কেউ কথা বলতে পারে না। ইশারায় ওদের মনেরভাব প্রকাশ করে। কুষ্টিয়ার ডিসি হয়ত ওদের মনের ভাব বুঝেই এ দায়িত্ব নিজেই কাধে তুলে নিয়েছিলেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বড় গেটে লেখা শুভ বিবাহ। কিছুদুর যেতেই দেখা গেলো সামিয়ানা টানানো নিচে কিছু চেয়ার বিছানো। পাশের ভবনটি ডরমিটরী ভবন। সেখানেই আয়োজন করা হয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠানের। পাশের একটি কক্ষে তিন কনেকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে একই আসনে।বর আসবে বলে অধীর অপেক্ষার প্রহর গুনছিলো জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা র্নিবাহী ম্যাজিষ্ট্রেটগণসহ সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। কারন আজ কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. জহির রায়হানের তিন কণ্যার বিয়ে। তবে বিয়েটি সত্যিকারে জেলা প্রশাসকের মেয়ে না হলেও আয়োজনে কোন কিছুরই কমতি ছিলো না। বিয়ের কণে তিন জন ইতি, হাওয়া ও উরুফা। তারা কুষ্টিয়া সামাজিক প্রতিবন্ধী ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে সেখানে অবস্থান করায় আঠারো বছর পেরিয়ে যাওয়ায় বিয়ের আয়োজন করা হয়। সেই মাহেন্দ্র দিনক্ষণ বুধবারেই মহাধুমধামের সঙ্গে তাঁদের বিয়ে দেওয়া হবে জেনে সকলেই আনন্দিত। তবে পুরো আয়োজনের উদ্যোক্তা কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক জহির রায়হান। কারন তার নিজের কোন মেয়ে না থাকায় সেই তিনজনকে নিজের কনে বলেও আখ্যায়িত করেছেন। ফলে বিয়ের শেষ না হওয়া পর্যন্ত সমস্ত আয়োজনের দেখভালো করেছেন তিনি নিজেই। দুপুরের দিকেই বিয়ের আসরে বর ও বরযাত্রীদের আগমণ। ফুল ছিটিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া পাশাপাশি ছিলো নানা পদের শরবত, মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা। এরপর বরযাত্রীসহ অতিথিদের আপ্যায়নেও ছিলো নানা রকম আয়োজন। প্রশাসন সূত্র জানায়, ইতি খাতুনকে প্রায় দেড় বছর আগে কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলায় পাওয়া যায়। সেখানে এক নারী কুমারখালী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন। পরে পুলিশের মাধ্যমে তাঁকে এই কেন্দ্রে আনা হয়। ইতি খাতুন তেমন কথা বলতে পারেন না। তবে ইশারায় সব জানাতে পারেন। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানাতে পারেননি। সেই থেকে এখানেই থাকেন। সম্প্রতি এক নারী যোগাযোগ করেন মেয়েটিকে তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য। জিল্লুর রহমান নামের ওই ছেলে এলাকায় ভ্যান চালান। হাওয়া খাতুন নামে মেয়েটি ৫ বছর আগে যশোর আহসানিয়া মিশন থেকে এই কেন্দ্রে আসেন। তিনি বাক্প্রতিবন্ধী। তবে অল্প একটু লিখতে পারেন। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানেন না। কেন্দ্রের এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে মেহেরপুর গাংনী উপজেলার মহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা সুজন আলীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সুজন কৃষি কাজ করেন। উরুফা খাতুনকেও ৫ বছর আগে যশোরের আহসানিয়া মিশন থেকে এই কেন্দ্রে আনা হয়। তিনিও নাম বলতে পারেন। তবে মা-বাবার নাম বা বাড়ির ঠিকানা বলতে পারেন না। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল এলাকার মৃত: রুস্তম আলীর ছেলে রেজাউলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হচ্ছে। রেজাউল একটি মার্কেটের নৈশ প্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. জহির রায়হান বলেন, আমার দুই ছেলে। কিন্তু কোন মেয়ে নেই। কুষ্টিয়া সামাজিক প্রতিবন্ধী ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের এই তিন মেয়ের বয়স পুর্ণ হওয়ায় বিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে জানান সমাজসেবা কর্মকর্তা। পরে আমিই তাদের বলি আমার তো কোন মেয়ে নেই। তাই তারা আমার মেয়ের মতো। জাকজমকপুর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের তিনজনকে বিয়ে দিতে চাই। এরপর কয়েক দফায় তিন বরের পরিবারে সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে একটি কমিটিও করা হয়। পরে উভয় পক্ষের সম্মতিতেই বিয়ের দিনতারিখ ধার্য করা হয়। এতে মেয়েদেরও সম্মতি নেওয়া হয়েছে। এবং তারাও আনন্দিত। গতকাল বিয়ের দিনে তিন মেয়ের সংসারে ব্যবহার্য জিনিসপত্র তুলে দেওয়া হয়েছে সাথে সাথেই। প্রত্যেক পরিবারকে ১৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, একটা মেয়ের বিয়েতে পরিবারের সদস্যরা যেরকম ভাবে থাকে, ঠিক একই ভাবে তিন মেয়ের পাশে থাকবেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের সহকারী ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান বলেন, গত রোববার কেন্দ্রে তিন মেয়ের এক সঙ্গে গায়েহলুদ হয়েছে। জেলার প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বরযাত্রী ও অতিথিদের খাওয়া দাওয়ার জন্য প্রায় আড়াইশ মানুষের জন্য আয়োজন করা হয়েছিলো।
এতে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক পত্মী শামসুন নাহার বেগম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) হাসান হাবিব, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোমিনুর রশীদ, স্থানীয় সরকাররে উপপরিচালক মোস্তাক আহমেদ, মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম জামাল আহম্মেদ, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটগন, জেলা সমাজসসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক রোখসানা পারভীন, সহকারী পরিচালক মুরাদ হোসেন, শহর সমাজসেবা অফিসার কেকেএম ফজলে রাব্বী, জিপি এ্যাড. আ স ম আক্তারুজ্জামান মাসুম, আওয়ামীলীগ নেতা হাজী তরিকুল ইসলাম মানিকসহ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাসহ গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। ভাগ্যবতী তিনজন উল্লেখ করে বিশিষ্টজনেরা জানান, এমন জেলা প্রশাসকের কারনেরই এখানকার একরকম বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে তাদের জীবনের আলো উদ্ভাসিত হচ্ছে। তবে এখানে আরও কিছু মেয়ে আছে তাদের এভাবে (বয়স পূর্ণ হলে) বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসিত করা হলে তারা নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে পাবে।