শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ধর্ষিতার নিরব কান্না থামবে কবে?

বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ধর্ষিতার নিরব কান্না থামবে কবে?

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:

১৯ বছরের এক গরীব যুবতী গৃহবধূ সালমা। শীতের এক রাতে ওই গৃহবধূ পিতৃগৃহ থেকে রিকশায় চেপে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ঢাকার মিরপুরে সনি সিনেমা হলের কাছে পৌঁছালে চারজন লোক তাঁকে জোরপূর্বক রিকশা থেকে নামিয়ে অস্ত্রের মুখে এক বাড়িতে নিয়ে যায়। রিকশাওয়ালাকে মারলে ও ভয় দেখালে সে পালিয়ে যায়। এরপর সেখানে নিয়ে ড্রইংরুমের মধ্যে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ চারজনের মধ্যে তিনজনকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করে ও অবশেষে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ আদালতে তাদের বিচার করা হয়। আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ও আরো দাবি করে যে সালমা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় পতিতাবৃত্তি করে এবং এ অবৈধ কাজে বাধা দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এ মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।

আদালতে সালমা আরজীর বিষয় বর্ণনা ও সমর্থন করে সাক্ষ্য প্রদান করেন। ওই ঘর থেকে পুলিশ টিভি, ভিসিআর, ক্যাসেট ও বন্দুক সিজ করে। সিজ করা টিভি ও বন্দুক কোর্টে প্রদর্শিত হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক সালমাকে পরীক্ষা করেন এবং তিনি আদালতে সাক্ষী দেন যে, সালমার পাঁজর, ঊরু, নিতম্বে আটটি জখম, অর্থাৎ ধস্তাধস্তির চিহ্ন পেয়েছেন এবং তাঁকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়েছে। মামলায় আরো ছয়জন সাক্ষী দেন। তাঁরা হলেন এজাহারের লিপিকার দারোগা, থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা, একজন সহকারী দারোগা ও একজন কনস্টেবল। অপর দুজন সিজারলিষ্টের সাক্ষী যাদের উপস্থিতিতে ঘটনাস্থল থেকে টিভি, ভিসিআর, ক্যাসেট ও বন্দুক জব্দ করা হয়েছিল।

সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির ভিত্তিতে ওই বিশেষ আদালত আসামি তিনজনকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী করেন এবং জরিমানাসহ সাত বছর সশ্রম কারাদ- দেন। এরপর দ-প্রাপ্তরা সাজার আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করে। বিচারপতি নঈমুদ্দিন আহম্মদ ও বিচারপতি গোলাম রাব্বানীর দ্বৈত বেঞ্চে বসাকালীন আপিলটির শুনানি হয় এবং নিম্ন আদালতের রায়টি সঠিক আছে বলে ওই বেঞ্চ আপিলটি ডিসমিস করে দেন। সেই সাথে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেন যে, যেহেতু ধর্ষিতা নিজেই জখমী, কাজেই তাকে জখমি সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সুতরাং ধর্ষিতাকে একজন সহযোগী ও তাকে অন্য সাক্ষী দ্বারা ঘটনাটিকে প্রমাণ করতে হবে এমন প্রাচীন আইনি ধারণা সঠিক নয়।

মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রুপ রায় ও আদেশের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়ে আসামী পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করে। আপিল বিভাগ প্রাচীন আইনি ধারণাটি অনুসরণ করে রায় প্রদান করেন। এই রায়ে বলা হয়েছে ‘এই মোকদ্দমার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী সালমা নিজেই ভিকটিম হওয়ায় এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে সালমা সত্য কথা বলেছে কি-না এবং তাঁর সাক্ষ্যের প্রত্যক্ষ বা অবস্থানগত সমর্থন প্রয়োজন কি-না।’ অতঃপর সালমার ও অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে আপিল বিভাগ সালমাকে অবিশ্বাস করেন। ফলে আপিল বিভাগ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ আদালতের রায় এবং মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাতিল করেন ও আসামি তিনজকে বেকসুর খালাস দেন। আপিল বিভাগের ওই রায়টি পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনস’-এর ১৩০০ খ-ের ৭৯৮৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।’

আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।

আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।

গুজরাট রাজ্যের গান্ধীনগর শহরে এক বাড়ীতে দুই বান্ধবী মিলে অপর বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যায়। ওই বান্ধবী তখন বাসায় ছিল না। বান্ধবীর পিতা ভারওয়াদা মিথ্যা কথা বলে বালিকা দুজনকে বাসার মধ্যে নিয়ে আসে এবং ধর্ষণ করার প্রস্তুতি নেয়। একজন বালিকা পালিয়ে যায়। কিন্তু অন্যটি ধর্ষণের শিকার হয়। বালিকাটির মা-বাবা তখন অন্যত্র ছিল। পাঁচ দিন পর তাঁরা গৃহে ফিরলে বালিকাটি ঘটনা প্রকাশ করে এবং তার মা-বাবা সংগত কারণে তা গোপন করেন। কিন্তু ইতোমধ্যে স্থানীয় মহিলা সমিতির সভানেত্রী ঘটনাটি জানতে পারেন এবং তাঁর উদ্যোগে আসামির বিরুদ্ধে মামলা হয়। ভিকটিম বালিকাকে একজন ডাক্তার পরীক্ষা করেন এবং তিনি যৌন নিপীড়নের আলামত পান। উভয় বালিকা আদালতে সাক্ষ্য দেয়। পাঠক! নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, মামলাটিতে বালিকা দুটির ও ডাক্তারের সাক্ষ্য ছাড়া আসামির বিরুদ্ধে আর কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ছিল না। দায়রা আদালত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তা গুজরাট হাইকোর্ট ও তারপর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখেন।

রায়ের প্রারম্ভেই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদ্বয় নিজেদের প্রশ্ন করেন এবং উত্তর খুঁজে পান এই মর্মে যে, সমর্থক সাক্ষ্য ছাড়া যৌন অপরাধের ভিকটিমের সাক্ষ্য বিশ্বাস না করার নীতি হচ্ছে ক্ষতের ওপর অপমানের জ্বালা যোগ করা। অল ইন্ডিয়া রিপোর্টসের সুপ্রিম কোর্ট অংশে ৬৫৮ পৃষ্ঠায় সিদ্ধান্তটি প্রকাশিত হয়েছে।

আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন ভীতি প্রদর্শন করিয়া বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করে তাহা হলে তিনি কোন নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে’। অর্থাৎ ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।

সাজার ধরণ দেখে একথা ষ্পষ্ট করে বলা যায় যে, একজন ধর্ষণকারী পশুরও অধম। প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক যে, একটি ধর্ষণ মামলায় অপরাধীর দোষ প্রমাণের মাপকাঠি কী? উত্তর হওয়া উচিত ধর্ষিতার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। অথচ এ সহজ উত্তরটির অধিকারিণী হতে বাংলাদেশের নারীসমাজকে এখনও অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে!

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।  মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel