শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
প্রিয়েমশন মামলা করে কিভাবে জমির অধিকার ফিরে পাবেন

প্রিয়েমশন মামলা করে কিভাবে জমির অধিকার ফিরে পাবেন

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার মালিগ্রামের রেজাউল, মিলন ও লিটন তিন ভাই। ভাইদের   মধ্যে সদ্ভাব নেই। তাদের বাবা মারা যাবার পর তারা বাবার জমি ভাগ করে নিয়েছে। প্রত্যেক ভাই এক বিঘা বাড়ির জমি ও দুই বিঘা মাঠের জমি পেয়েছে। মাঠের জমির ফসল ছাড়া তাদের তেমন কোন আয় রোগজার নেই। লিটন অসুখে পড়ে দেনাদার হয়ে গেছে। দেনা শোধ করার জন্য সে তার বাড়ির জমি থেকে দশ শতাংশ জমি বেচে দেবে। এছাড়া মাঠের কৃষি জমিও বেচে দেবে। লিটন পশ্চিম পাড়ার লোকমানের কাছে জমি বেচার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছুতেই সে ভাইদের কাছে জমি বেচবে না। ভাইয়েরা যাতে মামলা করে সুবিধে করতে না পারে সেজন্য দলিলে জমির দাম বেশি উল্লেখ করে রেজিস্ট্রি করেছে।
বাপ-দাদার ভিটার জমি অন্য লোকে বাইরে থেকে এসে কিনে নিবে তা বড় ভাই রেজাউল কিছুতে সহ্য করতে পারে না। রেজাউল শুনেছে শরিকদের জমি কেনার জন্য তারা আইন অনুযায়ী অগ্রাধিকার পাবে। বাইরের লোক যদি কোন জমি কিনে নেয় তবে দেওয়ানি আদালতে মামলা করে সেই জমির দাম তাকে ফেরত দিয়ে জমি নিয়ে নেয়া যায়। এই মামলাকে অগ্রক্রয় বা প্রিএমশন মামলা বলে।

 

রেজাউলদের পাড়ার খলিলুর রহমান জেলার কুমারখালী উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে চাকরি করেন। ভূমি আইন জানার ব্যাপারে তার নাম-ডাক আছে। রেজাউল খলিলুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে এ বিষয়ে আইন জানতে চাইল। খলিলুর রহমানের কাছে শুনলো যে, আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করি। আমাদের পাড়ায় একজন নতুন আগন্তুক আসলে আমরা অসুবিধায় পড়ি। এছাড়াও শরিক বা পার্শ্ববর্তী মালিক বাদে অন্য কেউ কিনলে জমি খন্ডিত হয়। তাই বসবাস বা চাষাবাদের অসুবিধা হয়। এই অসুবিধা যাতে না হয় সে জন্য আইনে অগ্রক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। অগ্রক্রয় বা প্রিএমশন হচ্ছে কোন মালিকের তার অংশীদার বা পার্শ্ববর্তী জমির মালিক কর্তৃক অন্য কারও কাছে বিক্রি করা জমি বিক্রয় মূল্য ফেরত দিয়ে পুণ:কেনার অধিকার। অর্থাৎ লিটনের কাছ থেকে লোকমানের কিনে নেয়া জমি পুনরায় লোকমানের কাছ থেকে রেজাউল বা মিলনের কিনে নেয়ার আইনী অধিকার। জমি দাম অনুযায়ী সহকারী জজ বা যুগ্ম জেলা জজ কোর্টে মামলা করে এই অধিকার আদায় করা যায়। দেওয়ানি আদালতে মামলা করে রেজাউল বা মিলন এই অধিকার আদায় করতে পারে।

 

খলিল সাহেব আরো জানালেন কৃষি ও অকৃষি জমির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় আইনে কিছু পার্থক্য আছে। অকৃষি জমি বলতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা শহর এলাকার জমি বুঝায়। এছাড়া অন্য অঞ্চলের আবাসিক বা শিল্প-বাণিজ্য কাজে ব্যবহৃত জমিও অকৃষি জমি। বাদবাকি অন্যান্যা চাষাবাদের জমি কৃষি জমি। অকৃষি জমি ক্ষেত্রে রেজাউলের মত শরিক সূত্রে মালিক হলে তাদের অগ্রক্রয়ের অধিকার সবার আগে। এরপর কেনার মাধ্যমে যারা শরিক হয় তারা অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী সংলগ্ন জমির মালিক কোন সুযোগ পাবে না। কৃষি জমির ক্ষেত্রে ক্রয় এবং উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সংলগ্ন জমির মালিক অগ্রাধিকার পাবে।

 

রেজাউল সহকারী জজ কোর্টে মামলা করে প্রকৃত মূল্য ফেরত দিয়ে লোকমানের কাছে বিক্রি করা জমি ফেরত পেতে পারে। লোকমান দলিলে বেশি দাম উল্লেখ করে রেজিস্ট্রি করলেও প্রকৃত বিক্রিত টাকা এবং কৃষি জমি হওয়ার কারণে শতকরা ১০ টাকা হারে ক্ষতিপূরণ ফেরত দেওয়ার আদেশ দিতে পারে।

 

জমি বিক্রি বা হস্তান্তরিত হলে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস অংশীদারদের প্রতি নোটিশ জারি করে। এই নোটিশ জারি হওয়ার চার মাসের মধ্যে মামলা করতে হয়। নোটিশ জারি না হলে হস্তান্তরিত হওয়ার ঘটনা জানার চার মাসের মধ্যে মামলা করতে হয়। অগ্রক্রয়ের মামলা হলে কোর্ট থেকে অংশীদার বা পার্শ্ববর্তী মালিকদের নোটিশ দেয়া হয়। কেউ অগ্রক্রয় মামলা দায়ের করলে অন্যান্যরা কৃষি জমির ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের নোটিশ জারি হওয়ার দুই মাসের মধ্যে পক্ষভূক্ত হতে পারে। অকৃষি জমি ক্ষেত্রে মামলা দায়েরের নোটিশ জারির এক মাসের মধ্যে পক্ষভূক্ত হতে হয়। তবে ঘটনাগুলির মধ্যে কৃষি জমির জন্য যেটি আগে ঘটে সেই সময়ের মধ্যে কিন্তু অকৃষি জমির ক্ষেত্রে যেটি পরে ঘটে সেই সময়ের মধ্যে মামলা করতে হয়। মামলা দায়েরের জন্য ৫০০ টাকার কোর্ট ফি দিতে হয়।

 

অকৃষি জমির অগ্রক্রয় মামলা করতে হলে দলিলে যে দাম উল্লেখ থাকে সেই টাকা ছাড়াও আরো শতকরা ৫ টাকা আদালতে জমা দিতে হয়। কৃষি জমির ক্ষেত্রে এই হার শতকরা ১০ টাকা। অগ্রক্রয়ের আদেশ দেয়া হলে এই টাকা ক্রেতাকে ফেরত দেয়া হয়।
প্রিএমশন মামলা দায়ের করতে হলে আইন অনুযায়ী সম্ভাব্য ক্রেতাদের পক্ষভূক্ত করতে হয়। মামলা দায়ের হলে এদের উপর নোটিশ জারি হয়। কেউ পক্ষভূক্ত হতে চাইলে তাকে পক্ষভূক্ত করা হয়। অতঃপর জজ সাহেব সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে ক্ষতিপূরণসহ কেনা দাম ক্রেতাকে ফেরত দিয়ে শরিক, ক্রয়সূত্রে মালিক বা পার্শ্ববর্তী মালিকের নামে দলিল রেজিস্ট্রি করার আদেশ দিতে পারেন। জজ সাহেব শুনানি করার পর যদি প্রমাণ হয় আইন অনুযায়ী অগ্রক্রয়ের অধিকারীরা যাতে কিনতে না পারে সে জন্য যত টাকা লেনদেন হয়েছে দলিলে তার চেয়ে আরও বেশি টাকা দাম লেখা হয়েছে তবে সেই টাকা বাদ দিয়ে বাকি টাকা ক্রেতাকে ফেরত দেয়ার আদেশ দিতে পারে। একইভাবে জমি কেনার পর ক্রেতা ভূমি উন্নয়ন কর, মাটি ভরাট, বিদ্যুত লাইন, দেনা পরিশোধ ইত্যাদি উন্নয়নের ব্যাপারে কোন খরচ করলে সেই টাকাও ক্রেতাকে ফেরত দেয়ার আদেশ দিতে পারে। অকৃষি জমির ক্ষেত্রে এইসব খরচের উপর শতকরা বার্ষিক ৬.২৫ টাকা হারে সুদসহ ফেরত দিতে পারে। তবে কৃষি জমির ক্ষেত্রে সুদ দেয়ার আইন নেই।

 

মামলার পক্ষভূক্ত একাধিক ব্যক্তি অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবি করতে পারে। একাধিক ব্যক্তি অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবি করে মামলায় পক্ষভূক্ত হলে তারা নিম্নোক্তভাবে অগ্রাধিকার পাবে। (১) ক্রয় ছাড়া অন্যসূত্রে মালিক, যেমন উত্তরাধিকার, বাটোয়ারা, দান ইত্যাদি থাকলে ক্রয় সূত্রে মালিক ও পার্শ্ববর্তী মালিক পাবে না (২) ক্রয়সূত্রে ছাড়া অন্যভাবে মালিক না থাকলে ক্রয়সূত্রে মালিক পাবে তবে সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী মালিক পাবে না (৩) শুধু কৃষি জমির ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত দুই ধরনের মালিকের অবর্তমানে সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী জমির মালিক পাবে। সংলগ্ন একাধিক মালিকের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে (ক) প্রার্থীদের দখলীয় মোট জমির পরিমাণ (খ) সংলগ্ন জমিতে কোন বসতবাড়ি আছে কিনা (গ) সংলগ্নতার ব্যাপ্তি (ঘ) সংলগ্ন মালিকের প্রয়োজনীয়তা মাত্রা (ঙ) বিক্রিত জমির সাথে কোন এজমেন্ট বা সুখাধিকারের সম্পর্ক আছে কি না ইত্যাদি বিবেচ্য।
এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় মামলা করার কোন অধিকার নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক যদি কোন জমি কেনে তবে তার বিরুদ্ধে অগ্রক্রয় মামলা করা যায় না। বিনিময় বা ভাগ-বাটোয়ারা করা হলেও অগ্রক্রয় হয় না। স্বামী, স্ত্রী, পিতা, পিতামহ, নাতি-নাতনী, চাচা, ভাই, ভাগ্নে-ভাগ্নী, হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে দত্তক পুত্রের অনুকূলে উইল বা দান। মুসলমানদের অসিয়ত বা হেবা করার ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় মামলা করা যায় না। খাই-খালাসি বন্ধক, দেবোত্তর, ওয়াকফ, সম্পূর্ণ ধর্মীয় বা দাতব্য কারণে উৎসর্গিত হলেও অগ্রক্রয় চলে না। যাদের ৬০ বিঘা জমি আছে তারা অগ্রক্রয়ের অধিকার পাবে না। ৬০ বিঘার কম জমি থাকলে ৬০ বিঘা পূরণ করতে যে পরিমাণ জমি লাগে সর্বাধিক সেই পরিমাণ জমি অগ্রক্রয়ের মামলা করে পেতে পারে।

 

 

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel