বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
কুষ্টিয়ার নূরুল ইসলাম তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ভোরে ঢাকার গাবতলী পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তিন-চারজন ছিনতাইকারী মুহূর্তেই তাদের সর্বস্ব লুট করে নেয় এবং যাওয়ার সময় তার ভাইকে ছুরিকাঘাত করে যায়। ভাইয়ের প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রফিকুল ইসলাম যখন পার্শ্ববর্তী থানায় মামলা করতে যান তখন থানা থেকে জানানো হয় মামলা দায়ের করতে হলে ঘটনার বিবরণসহ লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে হবে। নূরুল ইসলাম দুশ্চিন্তায় পড়ে যান, কারণ তিনি পড়ালেখা জানেননা এবং আইনের এত মারপ্যাঁচও বোঝেননা। তখন থানায় উপস্থিত দালাল তাকে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে এজাহার লিখে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। উপায়ন্ত না দেখে নুরুল তাতেই রাজি হয়ে যান।
কুষ্টিয়ার রহিম তার মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে প্রতিবেশী বখাটে যুবক রিপন মিয়াকে প্রধান আসামী করে সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার দায়ের করেছিলেন। কিন্তু মামলার এজাহারের দূর্বলতা, বিলম্ব ও পর্যাপ্ত সাক্ষীর অভাবে তার মেয়ের হত্যাকারীরা নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে এখন তারই সামনে দিয়ে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায়।
শুধু কুষ্টিয়ার নুরুল ইসলাম কিংবা রহিম নয়, ঠিকমতো এজাহার দায়ের করতে না পারায় প্রতিনিয়ত অনেকেই বিচার পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফৌজদারী অপরাধের ক্ষেত্রে এজাহার দায়েরের মাধ্যমে অধিকাংশ মামলার সূচনা হয়। তাই পরবর্তীতে মামলার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে এজাহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু ঠিক ঠাকমতো এজাহার রুজু করার জন্য পর্যাপ্ত আইনি জ্ঞান ও দক্ষতা না থাকায় প্রায়ই আমাদের নুরুল ইসলাম কিংবা রহিমের মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। তাছাড়া আইনগতভাবে এজাহার লেখার পদ্ধতিও যথেষ্ট জটিল।
এজাহার কী
অপরাধী ও সংঘটিত আমলযোগ্য অপরাধের বিস্তারিত বিবরণসহ শাস্তি দাবী করে বা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে থানায় অপরাধের সংবাদ লিপিবদ্ধ করাকে এজাহার বলে। যা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী নামেও পরিচিত। অপরাধ সম্বন্ধে এ বিবরণ প্রথম দেয়া হয় বলে একে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বলে। আমলযোগ্য অপরাধ (ঈড়মহরুধনষব ড়ভভবহপব) হচ্ছে সেই অপরাধ যে অপরাধের দরুণ অভিযুক্তকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায়।
এজাহার লিখিত বা মৌখিক যে কোনভাবেই করা যেতে পারে। মৌখিক এজাহারের ক্ষেত্রে থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বিনামূল্যে ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে দিবেন এবং উক্ত ঘটনার বিবরণ তিনি তথ্য প্রদানকারীকে পড়ে শুনিয়ে আপত্তি না থাকলে তাতে তার স্বাক্ষর নিবেন। আর যদি তথ্য প্রদানকারী কোন সংশোধন আনতে চান তবে তা আনার পর স্বাক্ষর নিবেন। অন্যদিকে লিখিত এজাহারের বেলায় সংঘটিত অপরাধের বিস্তারিত বিবরণ স্বাক্ষরসহ দরখাস্ত আকারে সংশ্লিষ্ট থানায় দাখিল করতে হয়। প্রাপ্ত দরখাস্তের তথ্যাদি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এজাহারের জন্য নির্ধারিত বিপি ২৭ ফরমে তুলে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেন। তবে কোন কারণে থানা এজাহার নিতে না চাইলে সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে নালিশি মামলা রুজু করা যায়।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় এজাহার সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোন থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসারের নিকট কোন আমলযোগ্য অপরাধ সংঘঠিত হওয়া সম্পর্কে কোন সংবাদ মৌখিকভাবে প্রদান করা হলে তিনি বা তার নির্দেশক্রমে অন্য কেউ সাথে সাথে তা লিখে তথ্য প্রদানকারীকে পড়ে শুনাবেন এবং তথ্য প্রদানকারীর স্বাক্ষর নিবেন। লিখিতভাবে প্রদত্ত সংবাদের ক্ষেত্রেও তথ্য প্রদানকারী স্বাক্ষর করবেন। এই তথ্য বিবরণী উক্ত অফিসার সরকার কর্তৃক নির্দেশিত (বিপি ২৭) ফরমে লিপিবদ্ধ করবেন।
তবে অপরাধের সংবাদটি বিস্তারিত না হলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে এবং পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনী ঘটনা আমলে নিয়ে তদন্ত করতে পারবে। যেকোন ব্যক্তিই অপরাধ সংঘটন স্থলের নিকটবর্তী থানায় এজাহার রুজু করতে পারেন। এর জন্য তাকে ক্ষতিগ্রস্থ হবার প্রয়োজন নেই। তবে আমল-অযোগ্য অপরাধের ঘটনা তদন্ত করতে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতির প্রয়োজন পড়ে (দেখুনঃ রাষ্ট্র বনাম আবদুল গফফার মুন্সী এবং অন্যান্য, ৩৫ তম ঢাকা ল’ রিপোর্টের ৭৬ পৃষ্ঠা) ।
অভিযোগ থানায় আসার পর ক্রমানুসারে প্রতিটি অভিযোগের একটি নম্বর প্রদান করতে হবে। ইংরেজি মাসের প্রথম দিন মধ্যরাতের পরে কোনো অভিযোগ এলে, সংশ্লিষ্ট অপরাধ যখনই ঘটে থাকুক না কেন তা ওই মাসের প্রথম বা ১ নম্বর অভিযোগ হিসেবে গণ্য হবে এবং ওই মাসের শেষ দিনের মধ্যরাতের আগে সর্বশেষ অভিযোগটি সর্বশেষ নম্বর ভুক্ত হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী হন তাহলে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়টি পুলিশ সুপার অভিযুক্তের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন।
এজাহারে যেসব বিষয় উল্লেখ করতে হয়ঃ
ঠিকমতো এজাহার করতে না পারায় অনেকেই বাধ্য হয়ে টাকার বিনিময়ে দালালের সাহায্য নেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী না হওয়ায় এজাহারে এ সকল দালালেরা ঘটনার প্রকৃত বিবরণ তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ এজাহার দুর্বল হয়ে যায় এবং আসামির বিপক্ষে মামলা প্রমান করা কঠিন হয়ে পড়ে। এজাহার হলো ফৌজদারী মামলার ভিত্তি, তাই এজাহারে অপরাধী ও অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সতর্কতার সঙ্গে তুলে ধরতে হয়। এজাহারে তাই (১) সুস্পষ্টভাবে অপরাধীর নাম ও ঠিকানা (জানা থাকলে) উল্লেখ করা; (২) অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা যৌক্তিকভাবে লিপিবদ্ধ করা; (৩) অপরাধ সংঘটনের তারিখ ও সময় উল্লেখ করা; (৪) অপরাধের সংঘটনস্থল উল্লেখ করা; (৫) অপরাধ সংঘটনের কোন পূর্ব সূত্র বা কারণ থেকে থাকলে তার বর্ণনা তুলে ধরা; (৬) সন্ধিগ্ধ ব্যক্তিদের সম্পর্কে ধারণা দেয়া; (৭) অপরাধ পরবর্তী অবস্থা যেমন -সাক্ষীদের আগমন, আহত ব্যক্তির চিকিৎসা ইত্যাদি সম্পর্কে বর্ণনা; (৮) সাক্ষীদের নাম, ঠিকানা ইত্যাদি উল্লেখ করা; (৯) অপরাধীদের কেউ বাধা দিয়ে থাকলে তার ধারাবাহিক বর্ণনা করা; (১০) কোন বিষয় তাৎক্ষনিকভাবে লেখা সম্ভব না হলে পরবর্তীতে সে বিষয়টি সংযোজন করা হবে এমন একটি কৈফিয়ত রাখা প্রভৃতি বিষয়াবলী উল্লেখ করা জরুরি। এছাড়া এজাহার দাখিলে কোন কারণে বিলম্ব হলে যথাযথ ও যৌক্তিক কারণ দর্শানো এবং কোন ঘষা-মাজা, কাটা-কাটি করা না থাকা ভাল। যদিও ফৌজদারী অপরাধের কোন তামাদি নেই, তথাপি এজাহার দায়েরে বিলম্ব মামলার গুনগতমান বিনষ্ট করে।
এজাহারের ৫টি কপি করতে হয়, তন্মধ্যে মূল কপি কোর্টে, প্রথম কার্বন কপি পুলিশ সুপার এর নিকট, দ্বিতীয় কার্বন কপি থানায়, সাদা কাগজে অতিরিক্ত কপি সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপারের নিকট এবং সাদা কাগজে অতিরিক্ত কপি এজাহারদাতার নিকট প্রেরণ করতে হয়।
এজাহার রুজুর পর পুলিশি দায়িত্বঃ
পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল (পিআরবি), ১৯৪৩ এর ২৪৩, ২৪৩(চ) ও ২৪৫ প্রবিধান এবং ফৌজদারী কার্যবিধির, ১৮৯৮’র ১৫৪ ধারানুযায়ীঃ আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ শুনে অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার ঋওজ গ্রহণ হতে বিরত থাকতে পারবেন না। এজাহার হলো জিআর পুলিশি মামলার মূল ভিত্তি। তাই আমলাযোগ্য কোন অপরাধের সংবাদ পাবার সাথে সাথে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৭ ধারানুসারে তদন্ত আরম্ভ করতে হবে। সংবাদদাতা সংবাদটি লিখিতভাবে দিতে না চাইলে অথবা তা লেখা হলে তাতে স্বাক্ষর দিতে না চাইলে সংবাদটি জিডিভূক্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিক তথ্যদাতা টেলিফোন/ফ্যাক্স/ইমেইল বা যোগাযোগের অন্য কোন মাধ্যম ব্যবহার করে এমনকি সংবাদপত্রের মাধ্যমে অবগত হয়ে কোন আমলযোগ্য অপরাধের সংবাদ দিলে সংবাদদাতাকে থানায় এসে এজাহার রুজুর জন্য বলতে হবে এবং তার নাম, ঠিকানা, খবরের উৎস প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করতে হবে, সংবাদদাতা থানায় না এলে সংবাদ গ্রহণকারী অফিসার নিজেই বিষয়টি ঋওজ করে ব্যবস্থা নিবেন (ধারা-১৬৭)। অপরাধ সংঘটনের সংবাদটি কোন আমলযোগ্য ঘটনার না হলে সেটি জিডি হিসেবে এন্টি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবাদদাতার স্বাক্ষর না দেবার কারণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বন্ধ রাখা যাবে না। সংবাদ পেলে ডাক্তারী কিংবা অন্যকোন প্রয়োজনীয় সার্টিফিকেট না পাওয়ার কারণে এজাহার বিলম্বিত করা যাবে না। ম্যাজিস্ট্রেট আমলযোগ্য কোন অপরাধ তদন্ত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিলে ম্যাজিস্ট্রেটের প্রেরিত লিখিত বার্তাই পুলিশ কর্মকর্তা এজাহার রূপে গণ্য করে পদক্ষেপ নিবেন (দেখুনঃ ৪৭তম ঢাকা ল’ রিপোর্টের ৯৪ পৃষ্ঠা)।
এজাহারের সাক্ষ্য মূল্যঃ
এজাহার হলো মামলার প্রারম্ভিক দলিল। এজাহার যেহেতু কোন অপরাধ সংঘটনের পর পরই দায়ের করা হয়, তাই এজাহার হলো সংঘটিত অপরাধের একটি বাস্তব চিত্র। তাছাড়া এজাহারের ওপর ভিত্তি করেই মামলার তদন্ত কাজ প্রাথমিকভাবে পরিচালিত হয়। এটি যে কোন মামলার প্রধানতম লিখিত দালিলিক সাক্ষ্য আর এ কারণেই মৌলিক সাক্ষ্য না হয়েও ফৌজদারী মামলায় এজাহারের গুরুত্ব অপরিসীম। এজাহারদাতা এবং এজাহারগ্রহীতার (সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার) মধ্যে অন্তত একজনকে মামলার সাক্ষ্য পর্বে আদালতে এসে সাক্ষ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে হয়। অন্যথায় মামলা দুর্বল হয়ে যায়।
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৪৫ ধারানুসারে এজাহারকে সাক্ষীর সাক্ষ্যের সত্যতা কিংবা অসংগতি প্রমাণের জন্য ব্যবহার করা যায়। অধিকন্তু, এজাহারের বক্তব্যের সঙ্গে সাক্ষ্য পর্যায়ে এজাহারকারী/গ্রহিতার বক্তব্যে অসংগতি ধরা পড়লে অপরাধ প্রমান করা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরাধের ধরণ ও অপরাধীদের আচরণ এজাহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও মামলার ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
জিডি ও এজাহারের পার্থক্যঃ
জিডি করা হয় অপরাধ সংঘটনের আশংকা থেকে, অপরদিকে এজাহার করতে হয় অপরাধ সংঘটনের পরপর। এজাহার কেবলমাত্র আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রেই দায়ের করা যায়, কিন্তু জিডি যেকোন অপরাধ এমনকি কোন কিছু হারিয়ে গেলেও করা যায়।
ফৌজদারী মামলার বিচারে এজাহার অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই বিচারকালে এজাহারে কোন ত্রুটি ধরা পড়লে তা আর সাধারণত সংশোধন করা যায়না। এজাহারের ওপর মামলার ভাগ্য অনেকখানি নির্ভর করে। একটি শক্তিশালী এবং নিরেট এজাহার একদিকে যেমন আইনের শত ব্যাখ্যার মধ্যেও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারে, অন্যদিকে ঠিক তেমনি দুর্বল ও অসঙ্গতিপূর্ণ এজাহার মামলার গুনগত মান নষ্ট করে বিচার বিলম্বিত করে আসামীদের জন্য বেকসুর খালাসের ব্যবস্থা করতে পারে। তাই এজাহার দায়ের করার পূর্বে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি এ বিষয়ে পুলিশের জন্য প্রশিক্ষণ ও বর্তমান প্রক্রিয়াটি সংশোধন করে এজাহারের জন্য জন বান্ধব ছক প্রবর্তন করাও অত্যাবশ্যক। তাহলে অন্তত প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণে আর কোন নুরুল ইসলাম কিংবা রহিমকে বিচার বঞ্চিত হয়ে চোখের জল ফেলতে হবে না।
থানায় মামলা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা ও পদ্ধতি
থানায় কোন অভিযোগকারী ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করলে তা প্রত্যাখ্যান করার এখতিয়ার আমাদের দেশের বিদ্যমান ও বর্তমান কোন আইনে নেই। পুলিশ স্টেশন বা থানায় মামলা বা অভিযোগ দায়েরের কথা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় উল্লেখ থাকলেও পুলিশ বাহিনীর বাইবেল বলে পরিচিত পুলিশ রেগুলেশন্স বেঙ্গল- ১৯৪৩ (পি আর বি)-এর ২৪৪ নম্বর প্রবিধানে অভিযোগ গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। পিআরবি-এর ২৪৪ (ক) প্রবিধানে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে- আমলযোগ্য প্রত্যেক অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশের সামনে প্রদত্ত প্রথম তথ্য রেকর্ড করতে হবে সেটা প্রাথমিকভাবে সত্য হোক বা মিথ্যা হোক কিংবা গুরুতর হোক বা ক্ষুদ্র হোক অথবা দ-বিধি বা অন্য কোন স্পেশাল বা আঞ্চলিক আইনের আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য যাহাই হোক না কেন। পিআরবি এর এই প্রবিধানে মামলা গ্রহণ বা রেকর্ড করার বাধ্যবাধকতায় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্যতিক্রমঃ ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৩৪ ধারা কিংবা পৌর, রেলওয়ে বা টেলিগ্রাফের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের জন্য তাহা প্রযোজ্য হবে না। এ বিষয়ে প্রবিধান ২৫৪ এ বিস্তারিত উল্লেখ আছে।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে থানায় যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে কেউ মামলা করতে পারবে কি-না? উত্তর হলো হ্যাঁ। তাহলে আবারও প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এভাবে মামলা হলে অগণিত মামলা হবে কি-না? এর উত্তরে বলা যায় অগণিত মামলা হবে সাধারণ দৃষ্টিতে। কিন্তু গভীর দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, যে কোন তথ্য মামলা হিসেবে রেকর্ড করার কথা আইনে বলা হলেও সব মামলার তদন্ত নাও হতে পারে। কারণ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৭ (১) (গ) ধারায় বলা হয়েছে যে, পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে যদি এটা প্রতীয়মান হয় যে, মামলাটির পর্যাপ্ত ভিত্তি নেই, তাহলে তিনি মামলাটির তদন্ত করবেন না।
আবার দ-বিধিতে উল্লেখিত ২১১ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়েরের পাল্টা ব্যবস্থা রাখার ফলে থানায় মামলা রেকর্ড করার সুবিধাটিকে পযবয়ঁব ধহফ নধষধহপব করা হয়েছে। কিন্তু আইনের কোন বিধান-এ পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সাব-ইন্সপেক্টরকে মামলা না নেয়ার ক্ষমতা বা এখতিয়ার দেয়া হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারায় এজাহার করা বা দায়েরের পদ্ধতি উল্লেখ থাকলেও থানার ডিউটি অফিসার বা অন্য যে কোন সাব-ইন্সপেক্টর বিভিন্ন অজুহাতে মামলা গ্রহণ না করে থাকেন। যেমন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এখন থানায় নেই, ইত্যাদি। কিন্তু আইনে ধরনের কোন অজুহাতের সুযোগ দেয়নি। অর্থাৎ পিআরবি-এর ২০৭ (গ) ধারায় পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে যখন কোন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং জুনিয়র সাব-ইন্সপেক্টর অনুপস্থিত বা অসুস্থ থাকেন তাহলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪ (ধ) ধারা অনুসারে সিনিয়র এসিসট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর থানার চার্জ এজিউম এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার যে কোন কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারবেন। ঁহধাড়রফধনষব পরিস্থিতি ছাড়া তিনি কখনও তদন্ত করতে পারবেন না। এমনকি সাব-ইন্সপেক্টর যখন অনুপস্থিত হন, তাহলে তিনি আমলযোগ্য অপরাধের কোন তথ্য পাওয়ার পর প্রাথমিক পদক্ষেপ অর্থাৎ তথ্যটিকে এজাহার হিসেবে রেকর্ড করবেন। যদি সাব-ইন্সপেক্টর থানার সীমানার কোন এলাকায় থাকেন তাহলে এসিসট্যান্ট সাব-ইন্সপেক্টর অভিযোগকারীকে তৎক্ষণাৎ এজাহারের একটি কপিসহ সাব-ইন্সপেক্টরের কাছে পাঠাবেন। শুধু সাব-ইন্সপেক্টর তার এখতিয়ার থেকে অনুপস্থিত বা অসুস্থ থাকলে সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর নিজেই তদন্তভার গ্রহণ করবেন। আইনের কোন বিধান এ পুলিশ স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা সাব-ইন্সপেক্টরকে মামলা না নেয়ার ক্ষমতা বা এখতিয়ার দেয়া হয়নি। থানায় মামলা না নেয়ার অপরাধে যে শাস্তি হতে পারে তা পুলিশ আইন ১৮৬১ এর ২৯ নম্বর ধারায় পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে।
থানায় মামলা গ্রহন না করার অপরাধ ও শাস্তিঃ
১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ২৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন পুলিশ কর্মচারী যদি নিম্নলিখিত রুপে যে কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়, যথা-
১) কর্তব্যচ্যুতি কোন নিয়ম বা রেগুলেশন স্বেচ্ছাকৃত ভাবে অমান্য করা ও গাফিলতি এবং পূর্ণভাবে তা পালনে শৈথিল্য করা;
২) উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কোন বৈধ আদেশ ইচ্ছাপূর্বক অমান্য করা বা গাফিলতি পূর্বক তা পালনে শৈথিল্য করা। তবে তাকে বিচারার্থে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সোপর্দ করা চলবে এবং বিচারে অপরাধী প্রমাণিত হলে ৩ মাসের বেতনের সমপরিমাণ জরিমানা অথবা তিন মাস পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ- অথবা উভয়বিধ দ- হতে পারে। আইনের এই বিধান মামলা না নেয়ার অপরাধকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে রোধ করার ব্যবস্থা করেছে। উল্লেখ্য, এখানে নিয়ম বা রেগুলেশন লংঘন বা গাফিলতি বলতে পিআরবি-এর মামলা গ্রহণ সংক্রান্ত ২৪৪ নিয়মের লংঘনকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ থানায় পুলিশ মামলা গ্রহণ করেননি, এটা প্রমানিত হলে তার উপরোক্ত শাস্তি হবে।
থানায় মামলা গ্রহন না করার প্রমাণ কিভাবে করবেনঃ
থানায় মামলা না নেয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য থানায় কমপক্ষে তিনজন ব্যক্তি যাওয়া উচিত এবং থানায় প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় উল্লেখ সহ কর্তব্যরত ডিউটি অফিসারের নাম ভালভাবে জানতে হবে এবং ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৪২ ধারা অনুসরণ করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রত্যেক জেলায় পুলিশের বিরুদ্ধে পিআরবি এর আচরণভিত্তিক অপরাধের শাস্তি প্রদানের জন্য ‘স্পেশাল পুলিশ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা দরকার এবং সঙ্গে সঙ্গে একটি থানায় কি অধিকার বিদ্যমান আছে সে সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে ।
মামলার কপি সরবরাহে বাধ্যবাধকতাঃ
থানায় মামলা হয়েছে কিনা-এ ব্যাপারে সাধারণ জনগণ জানার জন্য থানায় গিয়ে মামলার কপি চাইতে গেলে বিড়ম্বনায় পড়েন। অথচ সাক্ষ্য আইনের ৭৪ নং ধারা অনুযায়ী থানায় রক্ষিত রেজিস্ট্রারে রেকর্ডের মামলার কপি যে কোন ব্যক্তি পদ্ধতিগতভাবে অর্থাৎ আইনগত ফি প্রদানের মাধ্যমে পাওয়ার অধিকারী কেননা ওই ধারা অনুযায়ী রেজিস্টারে রক্ষিত মামলা পাবলিক ডকুমেন্ট।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক দৈনিক ‘ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮