এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারে। স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কিছু দেয়, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে ‘দেনমোহর বাবদ’ কথাটি লেখা থাকতে হবে। যেমন: জমি হস্তান্তর দলিলে ‘দেনমোহর বাবদ’ কথাটি লেখা না থাকলে এরূপ জমি প্রদান দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে না।
হাইকোর্ট বিভাগের একটি মামলায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বিয়ের সময় স্বামী তার স্ত্রীকে দেনমোহর হিসেবে ৫ বিঘা জমি দিতে চায়। সেমতে স্বামী উক্ত জমি স্ত্রী বরাবর প্রদানও করেন। পরবর্তীতে স্বামী তার স্ত্রীর সাথে এই মর্মে মধ্যস্থতা করে যে, উক্ত ৫ বিঘা জমি বিক্রি করে ভাল জায়গায় ১৩ বিঘা জমি ক্রয় করবে। সেখান থেকে স্ত্রীকে ৫ বিঘা জমি ফেরত দিবে। কথা দিয়ে কথা না রাখলে স্ত্রী স্বামীর কাছে দেনমোহর চেয়ে মামলা করে। স্বামী উক্ত মামলায় প্রতিযোগিতা করে। স্বামী এই মর্মে অজুহাত উত্থাপন করে যে পারিবারিক আদালতে উক্ত মামলা অচল। কারণ তিনি জমিটি ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং মামলাটি দেওয়ানি আদালতে বিচার্য। মামলাটিতে পারিবারিক আদালত স্ত্রীর পক্ষে ডিক্রি প্রদান করলেও স্বামী হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করে। মহামান্য হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখে ১৩ বিঘা জমির মধ্যে ৫ বিঘা জমি তার স্ত্রীকে প্রদানের নির্দেশ দেন। (রওশন আরা বেগম বনাম মাসক আহমেদ ২৩ বি.এল.ডি. হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা- ৩০২)
তবে মোহরানার পরিবর্তে হিবা বিল এওয়াজের রীতিও রয়েছে। ১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, মোহরানার পরিবর্তে হিবা-বিল-এওয়াজ তখনই বৈধ হবে যখন স্ত্রী কোনো প্রতিদান ছাড়াই স্বামীকে মোহরানা দান করে দেয় এবং পরে স্বামী স্ত্রীর দানের ‘এওয়াজ’ স্বরূপ কোন সম্পত্তি আলাদাভাবে দান করে। কারন এটা মুসলিম আইনে একটি বিশুদ্ধ হিবা বিল এওয়াজ। এমনকি স্বামী যদি স্ত্রীকে কোন কিছু দান করেন এবং স্ত্রী স্বামীর বরাবরে প্রতিদান স্বরূপ অন্য কোন দলিল মূল্যে মোহরানার অধিকার ছেড়ে দেয় তবে তা আধুনিক প্রকৃতির একটি হিবা বিল এওয়াজ বলে গন্য হবে। ( পিএলডি ১৯৫৫, ঢাকা. পৃষ্ঠা ৩৯)। দেনমোহরের পরিবর্তে স্ত্রীর বরাবর জমি সম্পত্তি হস্তান্তর একশত টাকা মূল্যের অধিক হলে অবশ্যই রেজিস্ট্রি দলিল দ্বারা হস্তান্তর করতে হবে। (৪ ডিএলআর, পৃষ্ঠা-৫১)
বিয়ের সময়ে দেয়া শাড়ী, গয়না ইত্যাদি কখনো দেনমোহরের অংশ হিসাবে বিবেচিত হবেনা। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে উসুল লিখে নেয়া হয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলোকে দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুল বলা যাবে না।
ভরণপোষণ দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে নাঃ
দেনমোহরের সাথে ভরণপোষণের কোন সম্পর্ক নেই। বিবাহিত অবস্থায় স্ত্রীকে ভরনপোষনের জন্য স্বামীর যে খরচ তা কোনভাবেই দেনমোহরের অংশ বলে বিবেচিত হবে না। আবার বিয়ে-বিচ্ছেদের ফলে স্বামী, স্ত্রীকে যে ভরণপোষণ দেয় তাও দেনমোহরের অংশ নয়। দেনমোহর এবং ভরণপোষণ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। একটি পরিশোধ করলে অপরটি মাফ হয়ে যায় না।
জামিনদারঃ
যদি কোন ব্যক্তি একজনের স্বামীর স্ত্রীর মোহরানার দায়িত্ব নেয় তবে সে উহা পরিশোধের জন্য দায়ী হবে। বিবাহ উত্তর দেনমোহরের জন্য জামিনদার থাকলে সেক্ষেত্রেও জামিনদার দায়ী হবে। স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। বিধবা স্ত্রী তার দেনমোহরের জন্য মৃত স্বামীর ত্যক্ত সম্পত্তি দখলে রাখার অধিকারিনী। (বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ, ১৮৭১, ১৪ এম.আই. এ. পৃষ্ঠা-৩৭৭)। দেনমোহরের দাবীতে কোনো বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি দখল করে থাকলে যদি তাকে উক্ত সম্পত্তি থেকে অন্যায়ভাবে বেদখল করা হয়, তবে সে দখল পুণরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। (মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব, ১৯১৬, ৪০ বম. পৃষ্ঠা-৩৪)।
যদি স্বামীর উত্তরাধিকারীরা স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন। উল্লেখ্য, যদি স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা ওই দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। ফলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা দেনমোহর পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করতে পারেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী,আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com