রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৯ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
বিয়ের দুই দিনের মাথায় স্বামীর সাথে তালাক হয়ে যায়। কাবিননামায় যে পরিমাণ অর্থ উল্লেখ ছিল সে পরিমাণ অর্থ স্ত্রী দাবি করে ওই স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই মামলায় স্বামী অর্থাৎ মামলায় যিনি বিবাদীপক্ষ তিনি দাবি তোলেন যে, কাবিননামায় উল্লিখিত অর্থের পরিমাণ ঠিক নয়। বিবাদী পক্ষ উক্ত মামলার জবাবে দম্পতির সহবাস সংগঠনের আগে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে বলে দাবী করে সাকুল্য মোহরানার অর্ধেক পরিশোধ করতে রাজী হয়। এক্ষেত্রে যদি স্বামী সমুদয় অংশ প্রদান করেন তবে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সহবাস যদি হয়ে থাকে, তবে স্বামী সমুদয় মোহরানার টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য। তবে বলে রাখা উচিত সহবাস হয়েছিল কি-না তা প্রমাণের সম্পূর্ণ দায় বাদীপক্ষের অর্থাৎ স্ত্রীর। অর্থাৎ স্বামী দাম্পত্য মিলনের পূর্বে স্ত্রীকে তালাক প্রদান করলে স্ত্রী অর্ধেক মোহরানা পাবে। যদি স্বামী দাম্পত্য মিলনের পূর্বেই মারা যায় তাহলে স্ত্রী সম্পূর্ণ মোহরানা পাবে। (তাজবি বনাম নাতার শেরীফ, ১৯৪০, ২ এম.এল.জে. পৃষ্ঠা-৩৪৫)।
স্বামী দাম্পত্য মিলনের পূর্বে স্ত্রীকে তালাক দিলে দেনমোহরের পরিমান অর্ধেক হবে; কিন্তু দাম্পত্য মিলনের আগে স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকে সম্পূর্ন দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। (মুহাম্মদ জামান বনাম নাইমা সুলতানা, ১৯৫২, পেশোয়ার ৪৭)।
যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর কাছে নির্ধারিত দেনমোহর চেয়ে না পায়, তবে সে স্বামীর সাথে বসবাস করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। দাম্পত্য মিলনে অনীহা প্রকাশ করতে পারে। এমন কি সে দূরে বসবাস করতে পারে। এতোসব পরেও স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে৷ এসময় কোনো স্বামী যদি দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করে, তবে তার মামলা খারিজ হয়ে যাবে, কারণ স্বামী, স্ত্রীর দাবী অনুযায়ী দেনমোহর পরিশোধ করেনি। (১১ ডিএলআর, পৃষ্ঠা-১২৪)।
দেনমোহরের দুটো অংশ যথাক্রমে মুয়াজ্জল (আশু) দেনমোহর অন্যটি মু-অজ্জল (বিলম্বিত) দেনমোহর।
প্রথমটি হচ্ছে, নগদে স্ত্রীকে প্রদান করা অর্থাৎ বিয়ের আসরে দিতে হয়। বিয়ের আসরে না দিতে পারলে পারিবারিক জীবন চলাকালীন সময়ে দেনমোহরের যে অংশটুকু স্ত্রী চাহিবামাত্র স্বামী পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। যদি না দেয় তাহলে স্ত্রী স্বামীর সাথে সহবাস অস্বীকার করতে পারে। (রাহিলান বনাম সানাউল্লা, ১৯৫৯, পি. লাহ. পৃষ্ঠা-৪৭০)। অপরটি হচ্ছে দেনমোহরের যে অংশটুকু স্বামীর মৃত্যুর পর কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের পর স্ত্রী পেয়ে থাকে। আরও পরিস্কার করে বলা যায় যে, আইন অনুযায়ী কেবলমাত্র দুইটি পরিস্থিতিতে বিলম্বিত মোহরানা স্ত্রী দাবি করতে পারেন। একটি হচ্ছে যদি স্বামীর মৃত্যু হয় অথবা তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। অপরটি হচ্ছে, যদি স্বামী সালিসি পরিষদ অথবা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করেন।
দেনমোহর কোনো স্ত্রীর ভরণপোষণ নয়। এটি বিয়ের পর স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত কোনো উপহারও নয়। বরং বিয়ের সময় স্বামীর কাবিননামায় প্রতিশ্রুত অর্থ। যা স্বামী কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারেন না।
(আঃ কাদের বনাম সালিমা, ১৮৮৬, ৮ অল. পৃষ্ঠা-১৪৯)।
স্ত্রী তার দেনমোহরের টাকা না পেলে সে এবং তার মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীগন এর জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। আশু দেনমোহর স্ত্রী চাহিবা মাত্র স্বামী দিতে বাধ্য। স্বামী দিতে অস্বীকার করলে বা না দিলে সেদিন থেকে তিন বৎসরের মধ্যে স্ত্রীকে মামলা দায়ের করতে হবে। বিলম্বিত দেনমোহর আদায়ের সময়সীমা হল মৃত্যু অথবা তালাকের ফলে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলে ওই তারিখ হতে তিন বৎসরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। তা না হলে মামলা তামাদি হয়ে যাবে।
স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক প্রদানের পর স্ত্রী যেই আদালতের এলাকায় বসবাস করেন ওই আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। এর জন্য মাত্র পঁচিশ টাকা কোর্ট ফি দিতে হয়। মোজাহেদুল ইসলাম বনাম রওশন আরা (২২ ডি.এল.আর, পৃষ্ঠা-৬৭৭) মামলায় বলা হয়েছে, দেনমোহর কখনই মাফ হয় না। স্বামী যদি মারাও যায় তবে সে স্বামীর সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যায়। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর যদি স্ত্রী সমুদয় অথবা শুধুমাত্র বিলম্বিত দেনমোহরের অর্থ অনাদায়ী থেকে থাকে। তবে স্ত্রী তার প্রয়াত স্বামীর ভূ-সম্পত্তি দখল করত উহার রাজস্ব বা মুনাফা হতে তা উসুল করতে পারে। (বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ, ১৮৭১, ১৪ এম.আই. এ. পৃষ্ঠা-৩৭৭)। কেননা ইসলামী আইনে দেনমোহরকে দেনা বলে বিবেচনা করা হয়। দেনমোহরের পরিমাণ যত বেশি হোক না কেন, পক্ষগুলোর মধ্যে স্বীকৃত হলে স্বামী তা সম্পূর্ণ রূপে স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। এমনকি স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও আদালত দেনমোহরানার দায় হতে স্বামীকে মুক্তি দেবে না। মোহামেদ সুলতান বেগম বনাম সারাজ উদ্দিন আহমেদ, ১৯৩৬, ১৬১ আই.সি. ৩০০)। স্ত্রীর ইচ্ছায় তালাক হলেও সে সম্পূর্ণ দেনমোহর পেতে অধিকারিণী যদি বিয়ে পরবর্তী যৌণ মিলন হয়ে থাকে। (এ.এম. ইব্রাহিম বনাম মামা এবং অন্য একজন, ১৯৩৯, র্যাং, পৃষ্ঠা-৩৮৩)।
পবিত্র কোরানে উল্লেখ রয়েছে,‘স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে মোহরানা পরিশোধ করা হয় প্রধানত দুইটি কারণে একটি হচ্ছে, ধর্মীয় অধিকার লাভের জন্য এবং অপরটি হচ্ছে, স্ত্রীর প্রতি একটি দায় বা কর্তব্য সম্পাদনের জন্য।’ এমনকি স্ত্রী যদি ক্রীতদাসীও হয় ,তবুও মোহরানা তার হক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের আরো সিদ্ধান্ত রয়েছে যে, এ অবস্থায় স্বামী দাম্পত্য স্বত্ব পুনরুদ্ধারের মামলায় ডিক্রি পেতে পারেন না। পাকিস্তান ল ডাইজেস্ট (১৯৫৯) লাহোর এর ৭১০ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে, স্ত্রীকে মোহরানা দেয়া হয়েছে কি-না যিনি তা পরিশোধ করেছেন তাকেই তা প্রমান করতে হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী,আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮