সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫৫ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
বস্তির টিনসেট ভাড়া বাসা যেন রহিমার স্বপ্নবিলাস। বিদ্যুতের বাতি, সাপ্লাইয়ের পানি, নাগরিক জীবনের অধিকার কিছুই প্রয়োজন নাই তার। স্বামী আর তিন সন্তান নিয়ে সুখের পরিবার। প্রত্যাশার চাইতেও যেনো অনেক বেশী পাওয়া হয়েছে। স্বামী রুপবান সেখ একজন রিকশা চালক। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীর রিকশা কিনে দিয়েছে। সপ্তাহে ২৫০ টাকা কিস্তি পরিশোধে রীতিরকম যুদ্ধ করতে হয়। সেকারণ বারো বছর বয়সী প্রথম মেয়ে পাশের বাড়িতে ঝি হিসেবে কাজ করে। মেঝো মেয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়ে। সবার ছোট দু’ বছরের ছেলে।
বিয়ের প্রথম জীবনে যৌতুক না আনার অপরাধে শশুড়-শাশুড়ীর যৌথ নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। অনেক কষ্টে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। ছোটবেলায় নিজ চোখে নদীতে বাব-দাদার বসত বাড়ি বিলীন হতে দেখেছে। বাবার বাড়িতেও ঠাঁই নেই। শহরে এসে ভালই কাটছিল রহিমার জীবন। হঠাৎ এক ঝটিকা ঝড় এসো যেনো রহিমার জীবন-সংসার তছনছ করে দেয়।
স্বামী রুপবান সেখের চলাফেরায় কিছু পরিবর্তন দেখতে পায় রহিমা। লাল শার্ট গায়ে রিকশা চালানো দেখে রহিমার মন খারাপ হয়ে যায়। রাতের রিকশা চালানোর কথা বলে অধিক রাতে বাড়ী ফেরে রুপবান। রাত-বিরাতে বাড়ী ফেরার কথা জানতে চাইলেই সে উত্তেজিত হয়ে যায়। স্বামীর উত্তেজনা দেখে অতীতে শশুড় বাড়ী থাকা অশান্তির কথা মনে করিয়ে দেয় রহিমার। সব নিরবে সহ্য করতে থাকে। ইদানিং রুপবান সেখের অন্যত্র রাত্রিযাপনে চিন্তিত হয়ে পড়ে রহিমা। দারিদ্রতা থাকলেও সংসারে সুখের কোন ঘাটতি ছিলো না। দু’বেলা পেট পুড়ে খাওয়ায় যেন তাদের অনেক প্রাপ্তি।
রহিমা কোনো কিছুই বিশ্বাস করতে চায় না। তার মনে পড়ে বিয়ের দিনের প্রতিশ্রুতির কথা। রহিমার হাত ধরে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে বলেছিলো ‘তুমিই আমার জীবন সাথী’। স্বামী কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলো। ডাক্তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। একদিকে রহিমা অন্যদিকে মৃত্যু, সে লড়াইয়ে রহিমার জয় হয়েছে। একজন নারীর জীবনে স্বামীই যেনো সব। কর্মক্ষম স্বামী, পাশে একজন প্রেরনাময়ী নারী, সুখ-সফলতা অবশ্যম্ভাবী।
সুখ-দুখের স্বপ্নে গাঁথা রহিমার দাম্পত্য জীবন। স্বামী সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রহিমাকে নিয়ে শহরের সব অলি-গলি চিনিয়ে দেয়। মাঝে-মধ্যে সিনেমা দেখে। শহরের ট্যুরিষ্ট স্পটগুলোতে গিয়ে ধনী দম্পতিদের মতো ওরাও ঝাল-মুড়ি খায়। সত্যিই রহিমা অনেক সুখী। স্বামীকে জীবন দিয়ে আগলে রাখে। এতো সুখ সইবে কি-না মাঝে মধ্যে চিন্তিতও হয়ে পড়ে রহিমা। একদিন রুপবান সেখের হাওলাত করা ফুলপ্যান্ট পড়া দেখে রহিমার সন্দেহ আরো প্রবল হয়ে উঠে।
স্বামীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে সে। অবশেষে তার সন্দেহ সত্যি হলো। রুপবান সেখ রহিমার অনুমতি না নিয়ে পাশের বস্তির এক স্বামী পরিত্যক্তা নারীকে বিয়ে করেছে। শশুর বাড়ীতে দরজা বন্ধ করে উচ্চশব্দে গান শুনছে। এদিকে রহিমার হৃদয় ভাঙা আত্মচিৎকারে ওই বিয়ে বাড়ি যেনো প্রকম্পিত। রুপবান সেখ রেগে বাঘ। তার নুতন শশুর বাড়ীতে রহিমার উপস্থিতি। তাও উচ্ছস্বরে চিৎকার, এটা যেনো জঘন্যতম অপরাধ। এই অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। একজন মুসলিম পুরুষ চারটি বিবাহ করা অন্যায় নয়। এই রকম অকাট্য যুক্তি ধর্মীয় বিধানের সাথে মিশ্রিত করে রুপবান এ বিয়েকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। একে একে পাড়া প্রতিবেশী জড়ো হলো, যার যার মত করে যুক্তি আর সান্তনা দিলো। সকলেই একমত রুপবান যদি ভরণপোষণের ক্ষমতা রাখেন, সমতার দৃষ্টি রাখে, তাহলে আরো দুইটি স্ত্রী নিতে বাঁধা কোথায়!
রহিমা পাগলের মতো বিচারের জন্য ছুটে বেড়ায় এখানে-সেখানে। ছিন্ন-ভিন্ন দ্বি-খন্ডিত হৃদয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে। শত দারিদ্রতা, কষ্ট আর অভাবের মাঝেও স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো না। একটা ছেঁড়া কাপড়, অন্যের বাসায় কাজ করে নিজে না খেয়ে স্বামীর জন্য অন্ন সংস্থান, ঋণ করে স্বামীর রিকশা কিনে দেওয়া, জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নানা ভাবনায় রহিমার বুক ফেটে কান্না আসে। পৃথিবীতে ভালোবাসার কথামালা কি মিথ্যা! স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কি এতই ক্ষনস্থায়ী! প্রেম, দয়া, ভালোবাসা, সন্তানের জন্য ভবিষ্যত সবই কি বৃথা! স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গোপনের প্রতিজ্ঞা, দু’জনের স্বপ্নের বুনিয়াদ সবই কি মিথ্যা! রহিমার মন এসব প্রশ্নে উত্তর খুঁজে বিষণœতায় ভারাক্রান্ত। বৃষ্টির মত কাঁদতে ইচ্ছে করে। বৃষ্টির ভিতরে বজ্রপাতের মত অগ্নিকুন্ডলি নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দিতে চায় রুপবানের দ্বিতীয় সংসার।
রহিমার জীবন কাহিনী মন দিয়ে শুনলাম। আইনী সাহায্যে পেতে আমার চেম্বারের আগমন। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৬ (৫)(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ব্যতিত বা সালিশি পরিষদের অনুমতি ব্যতিত এক জন বিবাহিত পুরুষ ১ম স্ত্রী থাকা অবস্থায় ২য় বিবাহ করতে পারে না। যদিও প্রচলিত আইনে ২য় স্ত্রী এই অপরাধের আওতায় পড়বে না।
রহিমার ক্ষোভ স্বামীর চেয়ে সতীনের দিকে বেশী। এ কেমন আইন! যে আমার স্বামীকে কেড়ে নিল তার শাস্তি হবে না! অপরাধের ধারাও জামিন যোগ্য! রহিমাকে আদালতে গিয়ে বিচার চাইতে হবে। ২য় বিবাহের কাবিন দেখাতে হবে। আইনজীবী, মহুরী, পথভাড়া, পেশকার, পিয়ন, সর্বপরি রিকশার কিস্তির টাকা সব কিছু শুনে সে নির্বাক। আইনজীবীর খরচ বাদ দিয়ে আইনী সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিলাম। আদালতে যাওয়া-আসার পথ ভাড়াই তার নাই। মামলা করবে কিভাবে।
বিচার চাইতে টাকা খরচ করতে হয়। স্বাস্থ্য সেবা পাইতে টাকা খরচ করতে হয়। শিক্ষা অর্জনের জন্য টাকা খরচ করতে হয়। সরকারী সকল সেবা পাইতে টাকা খরচ করতে হয়। তাহলে রহিমার জীবনে রাষ্ট্রের আর কি প্রয়োজন থাকতে পারে। রহিমা জানতে চায় আসামী ধরার সাথে সাথে বিচার ও সাজা একই দিনে শেষ হবে কি-না? সর্বশেষ আইনী প্রতিকার পাইতে কত দিন সময় লাগতে পারে। এই রকম আইন জামিন যোগ্য কেন? এরকম নানা প্রশ্নবানে আমাকে জর্জরিত করে ফেলে রহিমা।
অবশেষে রহিমার বিচার প্রার্থী হওয়ার আকাঙ্খা ধুলিসাৎ হয়ে যায়। রুপবান সেখের দেখানো সকল স্বপ্ন রহিমার জীবনে মিথ্যা বালুচরে পরিণত হয়। রহিমার ঘর ভাড়া বাঁকী পড়ে যায়, স্বামী ও সংসার হারা হয়ে তিনটি সন্তান সহ এনজিও’র কিস্তির টাকা বাঁকী রেখেই গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু। শুধু রুপবান সেখের পাশবিকতায় চারটি জীবন অনিশ্চয়তার ধ্বংস্তুপে দাঁড়িয়ে। রাষ্ট্রের আইন আর রহিমার জীবনে কোন গুরুত্ব নেই। যে সমাজে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি এক দুর্লভ প্রক্রিয়া, সেই দেশে রহিমার বিচার প্রাপ্তি আর কি হবে।
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক রহিমাদের বিচার দিতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। রহিমার আইন প্রাপ্তির সুবিধা রাষ্ট্রীয়করণ করা এখন সময়ের দাবী মাত্র। এই দাবী তার সুযোগ নয় জন্মগত ও সাংবিধানিক অধিকার।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮