এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
পারিবারিক সমস্যা নিয়ে ১৯৮৫ সালে পারিবারিক আদালত গঠিত হয়। উদ্দশ্যে ছিল অল্প খরচে, স্বল্প সময়ে নারীর অধিকার দ্রুত নিষ্পত্তি করা। প্রতিটি উপজেলার জন্য একটি করে পারিবারিক আদালত আছে। এ আদালতের প্রধান একজন সহকারী জজ। বর্তমানে পারিবারিক সমস্যা বিচার করার এখতিয়ার শুধুমাত্র পারিবারিক আদালতের। তবে বিচার শুরু করার আগে পারিবারিক আদালতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল আপোস-মিমাংসার চেষ্টা করা। যদি আপোস-মিমাংসার চেষ্টা ব্যর্থ হয় তবে আদালত তার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। এই বিচার ওপেন কোর্টেও হতে পারে আবার রুদ্ধদ্বার কক্ষেও হতে পারে। যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত লিখিত রায় ও ডিক্রি দিয়ে থাকেন। আদালত ডিক্রির টাকা যে কোনভাবে পরিশোধের আদেশ দিতে পারেন (কিস্তির মাধ্যমেও)। আদালত ডিক্রির টাকা অনাদায়ে বিবাদীকে ৩ মাস বা টাকা পরিশোধ না হওয়া পযন্ত কারাদন্ড দিতে পারেন। সংক্ষুব্ধ পক্ষ ইচ্ছা করলে আদালতের রায়, ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা জজের আদালতে আপীল করতে পারবেন। তবে মোহরানা ৫০০০ টাকার বেশী না হলে কোন আপীল করা যাবে না। কেউ যদি পারিবারিক আদালত অবমাননার দায়ে (ধারা ১৯) দোষী হয় তবে আদালত তার জরিমানা করতে পারেন যা ২০০ টাকার বেশী হবে না। সমস্যা যে জেলায় উদ্ভব হয় সেই জেলার পারিবারিক আদালতে বা স্বামী-স্ত্রী সর্বশেষ যে জেলায় বসবাস করেন সেই জেলার আদালতে বা স্ত্রী যে জেলায় বসবাস করছেন সেই জেলার পারিবারিক আদালতে মামলা করতে হয়। মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুসারে বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পূণরুদ্ধার, শিশু সন্তানের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান, দেনমোহর ও খোরপোষ এ পাঁচটি বিষয় পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়।
মোহনা খাতুনের (ছদ্মনাম) একটি খোরপোশ-ভরণপোষণের মামলা আদালতে বিচারাধীন। দুই বছর আগে মামলা করেছেন তিনি। মামলা দায়েরের পর বিবাদীর কাছে সমন (মামলা সংক্রান্ত নোটিশ) জারি করতে আদালতের সময় লেগেছে এক বছর। এরপর প্রায় এক বছর ধরে বিচারকাজ চললেও মামলার খুব একটা অগ্রগতি নেই। অপরপক্ষ আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ায় তদবির করে মামলার ধার্য তারিখ দু-তিন মাস পর পর বিলম্বিত হচ্ছে। ফলে খোরপোষের এ মামলা যে কবে শেষ হবে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বাবার বাড়িতে নাবালক দুই সন্তানকে নিয়ে একারণে নিদারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটছে তার।
পারিবারিক আদালতে দেনমোহরের মামলা ঠুকেছেন সালমা খাতুন (ছদ্মনাম)। ২০০৯ সালের জুনে একই গ্রামের কামাল মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়েতে দেড় লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য হয়। পরবর্তীতে সালমা ও কামালের দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতি হলে সালমা দেনমোহরের এক লাখ টাকা দাবি করে নির্ধারিত পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত সালমার পক্ষে রায় দেন। কামাল মিয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। যথাসময়ে নিম্ন আদালত থেকে সালমা রায় পেলেও উচ্চ আদালতে দায়ের হওয়া নতুন এই আপিল মামলা চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য ও মনোবল তার নেই। মামলা করে যেন আরো বেকায়দায় পড়েছেন তিনি।
অধিকার আদায়ের সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে নারীরা আশ্রয় নেন পারিবারিক আদালতে। কিন্তু সেখানেও স্বস্তি নেই। আদালতের দীর্ঘসূত্রতা, মামলা চালানোর অর্থাভাব, অপর পক্ষ থেকে মানসিক চাপ সবমিলিয়ে নারী হয়ে পড়ে চরম দুর্দশাগ্রস্থ। কারণ পারিবারিক আদালতে স্বল্প খরচে, স্বল্প সময়ে মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হয় না। একজন নারী যিনি দেনমোহর বা মোহরানা আদায়ের মামলা দায়ের করেন, তাকে যদি বছরের পর বছর আদালতে ঘুরতে হয় তাহলে ন্যায়বিচারের আশা উবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারলেই যেন রেহাই পান আবেদনকারিণী।
যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় তাদের আদালত যোগে সমন পাঠানো হলেও সমন জারিকারকদের উদাসীনতা, অবৈধ সুবিধা গ্রহণ ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে যথাসময়ে সমন জারি হয় না। ফলে বিচারকাজ শুরু হতে অযথাই দেরি হয়। কখনো আবার ভুক্তভোগী নারীর পক্ষে পারিবারিক আদালত রায় কিংবা ডিক্রি প্রদান করলেও অপর পক্ষ উচ্চ আদালতে ওই ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করে। এতে আবেদনকারী নারীটির প্রাপ্য অধিকার দীর্ঘসূত্রিতার জালে আবদ্ধ হয়। এভাবেই পারিবারিক আদালতে নারীর স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।
আমাদের দেশের অধিকাংশ পারিবারিক আদালতগুলোর হাল-হকিকত এরকমই। পারিবারিক আদালতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচার প্রক্রিয়ার সনাতন পদ্ধতিগুলোর আধুনিক সংস্কার প্রয়োজন। যুগোপযোগী ও দ্রুততর বিচারিক পদ্ধতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে পারিবারিক আদালতকে 'নারীবান্ধব আদালতে' পরিণত করা জরুরি। ভাগ্যবিড়ম্বিত একজন অসহায় নারী যখন তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন-আদালতের দ্বারস্থ হন, তখন পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে কোনো নারী যেন ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হন সেদিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। আইনজীবী ও বিচারকসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ধরনের মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার ক্ষেত্রে আরো আন্তরিক ও যতœবান হওয়া উচিত। বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়া, যথাসময়ে সমন জারি না হওয়া এবং পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে বছরের পর বছর ধরে আপিল-মামলা ঝুলে থাকা কিংবা অন্য কোনো জটিলতার কারণে কোনো নারী পারিবারিক আদালতে আশ্রয় গ্রহণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেললে তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যাগুলো নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার আগে পারিবারিকভাবেই উভয় পক্ষের সম্মতিতে সমাধান করা হলে সেটা আরো বেশি কল্যাণকর। আদালতের সীমাবদ্ধতার এ জায়গাটায় এগিয়ে আসতে পারেন স্থানীয় গ্রাম আদালতও।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com