সোমবার, ০৫ Jun ২০২৩, ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ইবি প্রধান ফটক আটকে বিক্ষোভ, ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্ত্রী স্বামীর সংসারে না ফেরায় আইনগত প্রতিকার বনাম বাস্তবতা! মিথ্যা মামলায় জড়িত হলে কিভাবে প্রতিশোধ নিবেন? Protecting bidi industry from aggression of BAT demanded in Kushtia বাপ দাদা ও নানা বাড়ির সম্পত্তি কিভাবে উদ্ধার করবেন? বাবাকে ভর্তি কমিটিতে না রাখায় কর্মকর্তা সমিতির সভাপতিকে লাঞ্ছিত করলো ছাত্রলীগ সম্পাদক তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর যৌতুক মামলা বনাম আইনী বাস্তবতা! সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বিষোদগার বনাম মানির মান আল্লাহ রাখার গল্প! ব্যাচ ভিত্তিক অনুষ্ঠানে দ্বন্দ্বের জেরে বহিরাগতদের নিয়ে সহপাঠীকে মারধর চিরকালের রবীন্দ্রনাথ ও পদ্মা প্রবাহ চুম্বিত শিলাইদহ
কুমারী মায়ের সন্তানের স্বীকৃতি বনাম আইনী সফলতার গল্প

কুমারী মায়ের সন্তানের স্বীকৃতি বনাম আইনী সফলতার গল্প

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:

একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন শান্তা (কাল্পনিক)। আর সুজন (কাল্পনিক)  স্নাতক পর্যায়ের একটি কলেজে। ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। বাড়ি, স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে অনেকেই জানে ওদের বিয়েটা হতে যাচ্ছে। তাই ওদের অবাধ মেলামেশায় কেউই কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি ।

হঠাৎ সুজনের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখতে পায় শান্তা। অজুহাত দেখায় অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। অবশেষে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। দিন সাতেক আগে কলেজের এক শিক্ষিকাকে বিয়ে করেছে সুজন। কিন্তু শান্তা’তো ইতোমধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা। সত্যটা জানার পর বাড়ি থেকে প্রচন্ড চাপ আসে শান্তা’র উপর। কেউ বলছে আইনী পদক্ষেপ নিতে; আবার কেউ বলছে বাচ্চাটিকে গর্ভপাত ঘটাতে। একদিকে নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ, পারিবারিক মর্যাদা, সামাজিক সম্মান, লোক লজ্জার ভয় অন্যদিকে নির্দোষ একটা ভ্রূণ। নানা ভাবনার আবর্তে পাগল হয়ে উঠে শান্তা। নিজের সঙ্গে লড়াই করে রক্তাক্ত হয় প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে।

স্বাবলম্বী শান্তা এবার সিদ্ধান্তে পৌঁছায় কিছুতেই নিষ্পাপ ভ্রƒণটাকে নষ্ট করবে না। অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো, বাতাস, খুশি, আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আর সুজনকেও জানতে দেবে না তার পিতৃ-পরিচয়। আর এ সবকিছুর জন্য পুরো জীবনে যত লড়াই করতে হয় করবে। এ সন্তান হবে একান্তভাবেই ওর একার। শান্তার পরিচয়েই সন্তান এ ধরায় পরিচিত হবে।

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বাচ্চা পৃথিবীতে আসে। এবার পালা সন্তানের বার্থ সার্টিফিকেট। সার্টিফিকেটে বাচ্চার মা এবং অভিভাবক হিসাবে শান্তার নামটি লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু বাঁধ সাধে আইন। বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু করবার জন্য বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো বাধ্যতামূলক। কর্তৃপক্ষ শান্তার কাছে বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য জানতে চাই। উত্তরে শান্তা বলল এ বাচ্চা শুধুমাত্র ওর একার, বাচ্চার কোনও বাবা নেই। শান্তার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শান্তাকে সাফ জানিয়ে দেন এ বাচ্চার বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু হবে না। শান্তাও বাচ্চার পিতৃ-পরিচয় দাবি করে সুজনকে তার বিড়ম্বনার কারণ হতে চাই না।

আবেদন-নিবেদনে যখন কোন কাজই হলো না, তখন বাধ্য হয়ে শান্তা গেলেন পারিবারিক আদালতে। ১৮৯০ সালের গার্ডিয়ান এন্ড ওয়ার্ডস এ্যাক্ট এর ৭ ধারা মোতাবেক ওই বাচ্চার একমাত্র অভিভাবক ঘোষনার জন্য আবেদন জানান। ওই আইনের ধারা ১১ অনুযায়ী বাচ্চার সম্ভাব্য অভিভাবকদের নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক। এবার কোর্টও শান্তার বাচ্চার বাবার নাম জানতে চান। কিন্তু শান্তা নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শান্তা কোর্টকে জানিয়ে দেন বাচ্চার বাবা এই বাচ্চার জন্ম বিষয়ে কিছুই জানেন না। কাজেই তার নাম এখানে অপ্রয়োজনীয়। আদালতের রায় শান্তার বিরুদ্ধে যায়। তার আবেদন খারিজ করে দেন আদালত। নাছোড়বান্দা শান্তা এ রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে দ্বারস্থ হন উচ্চ আদালতে। কিন্তু, সেখানেও শান্তার আপীল খারিজ হয়ে যায়। শেষমেশ, শান্তা দ্বারস্থ হন সর্বোচ্চ আদালত আপীল বিভাগে। ফাইল করেন স্পেশাল লিভ পিটিশন।

এবার এলো এক যুগান্তকারী রায়। পত্রিকায় বড় বড় শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলো “কুমারী মায়ের আইনি স্বীকৃতি … অভিভাবক হতে বিয়ে জরুরী নয়।’

শান্তার মত মা যারা, তাঁদের প্রত্যেকেরই সামাজিক সম্মান ও একক মাতৃত্বের বিষয়টিকে আইনি স্বীকৃতি দিতে অবশেষে পথ দেখালো ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট (SLP (Civil) No. 28367 of 2015 : ABC Vs. The State NCT of Delhi)|

মামলায় আপীলটি অ্যালাউ করার সময় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে নির্দেশ জারী করেন যে, এ ধরণের মামলায় পারিবারিক আদালত পিতৃ-পরিচয় জানতে চাওয়া কিংবা ১১ ধারার বিধান মতে পিতার উপর নোটিশ জারির কোনো প্রয়োজন নেই। বাচ্চাটির সার্বিক কল্যাণের জন্য এবং অবশ্যই বাচ্চাটির জন্ম/উপস্থিতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়, এমন একজন ব্যক্তিকে, ¯্রফে তার স্পার্ম ব্যবহৃত হয়েছে এই কারণে কোর্টে উপস্থিত হওয়ার নোটিশ পাঠানোর কোনও প্রয়োজন নেই। পাঠক, আমরা আশা করছি, উচ্চ আদালতের এরুপ আদেশের পর শান্তার সন্তানের অভিভাবকত্ব পেতে আর কোনো বাঁধা রইল না।

সুপ্রিম কোর্টের আদেশানুসারেই ৬ই জুলাই, ২০১৫’ র উপরোক্ত আদেশটি অল ইন্ডিয়া রিপোর্টে প্রকাশিত হয়। এমন প্রত্যেকটি মামলার ক্ষেত্রেই দেশের সকল উচ্চ ও নিম্ন আদালতগুলিতে এই আদেশটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। এরপর থেকে কোনভাবেই আবেদনকারীর কাছে ‘বাচ্চার বাবা কে, বা তার ঠিকানা কী’ এ জাতীয় তথ্য জানতে চাইতে পারবে না। স্বাভাবিকভাবেই, সকল এই প্রকার মামলার ক্ষেত্রে ১১ ধারায় বাচ্চার বাবাকে অর্থাৎ নেচারাল ফাদার’কে নোটিশ পাঠানো আর বাধ্যতামূলকও রইলো না। এই আদেশটি নিশ্চয়ই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কাছে এক যুগান্তকারী পালাবদল।

কুমারী মায়ের বাচ্চার অভিভাবকত্বের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট আমাদের রাস্তা দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তো আর গণতন্ত্রের আইনসভা নয়, তাই দেশের পুরনো আইনে নির্দিষ্ট কোনও সংশোধন আনা, কিংবা দেশবাসীর জন্য নতুন আইন তৈরি করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারে পড়ে না। দেশের নির্বাচিত সরকারকেই এ বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে পার্লামেন্টে বিল আনতে হবে। পাশ করাতে হবে আইনের নতুন খসড়া। তৈরি করতে হবে মহিলাদের সমানাধিকার প্রশ্নে নতুন আইন।

আমরা চাই মহিলারা নিজের জীবন, বেঁচে থাকা, মাতৃত্ব, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিষয়ে পুরুষের সমান অধিকার পাক, অধিকার পাক নিজের সন্তানের ‘অভিভাবক’ হওয়ারও, আর তার জন্য যেন তাকে আর কোনদিন এক আদালত থেকে অন্য আদালতে দৌঁড়াতে না হয়।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel