শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের পর থেকে মুসলিম বিয়ে ও বিয়েবিচ্ছেদে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং নিবন্ধন না করাকে দ-নীয় অপরাধ হিসেবেও গণ্য করা হয়েছে। এরপরও নিবন্ধনহীন মুসলিম বিয়ে বৈধ হিসেবেই আইন ও সমাজের চোখে গণ্য হয়ে আসছে। আবার হিন্দু আইনে বিয়ে নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা এখন পর্যন্ত আরোপ করা হয়নি। কোনো মুসলিম বা হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন না হলেও দায়-দায়িত্ব কোনো পক্ষ অস্বীকার করতে পারে না।
মমতাজ বেগম ও আনোয়ার হোসেন একে অপরকে ভালোবাসেন। সে সূত্র ধরে দুজন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘর-সংসার করতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বিয়ের কোনো কাবিননামা রেজিস্ট্রি হয়নি। এক পর্যায়ে লোভী আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের কাছে যৌতুক দাবি করে নির্যাতন করে এবং যৌতুক না পাওয়ায় মমতাজ বেগমকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। মমতাজ বেগম তার ভরণপোষণ এবং দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা ঠুকে দেন। কিন্তু বিধিবাম! আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের সঙ্গে তার বিয়েকে অস্বীকার করে আদালতে জবাব দাখিল করে। এদিকে মমতাজ বেগম দাবি করেন, তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এবং তারা দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই একত্রে বসবাস করছেন এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে পারিবারিক আদালত আদেশ দেয়, তাদের মধ্যে বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। পারিবারিক আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ আনোয়ার হোসেন ১৯৯৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট বিভাগের একটি একক বেঞ্চ ১৯৯৯ সালে পারিবারিক আদালতের আদেশটি খারিজ করে দেন। হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে বলেন, তাদের মধ্যে কোনো প্রকার কাবিননামা সম্পন্ন হয়নি যা বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং মমতাজ বেগম তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগের এ রায়ের বিরুদ্ধে মমতাজ বেগম লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) দায়ের করেন এবং আপিল মঞ্জুর হয় তিনটি বিষয়কে বিবেচনা করে, যথা-
১. মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে রেজিস্ট্রি না হলে এটি কি বাতিল, অবৈধ বা অস্তিত্বহীন কি-না;
২. তিন বছর ধরে তাদের স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করা এবং বসবাসের শর্ত বৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে কি-না;
৩. হাইকোর্ট বিভাগ রিভিশনাল এখতিয়ার প্রয়োগ করে নিম্ন আদালতের আদেশ এবং পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বৈধ বিয়ের অস্তিত্বের বিষয়ে বিবেচনা করেছেন কি-না।
আপিল বিভাগে মমতাজ বেগমের পক্ষে ২০০৩ সালে আপিলটি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভুঁইয়া। সিভিল আপিল নাম্বার-১৩৯/২০০৩। তিনি আপিলে দাবি করেন, কাবিননামার অনুপস্থিতিতে বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে না এই মর্মে হাইকোর্ট বিভাগের বিবেচনা যুক্তিসঙ্গত নয় এবং তা আইনের সঠিক মর্ম নয়। অবশেষে ৩১ জুলাই ২০১১ তারিখে আপিল বিভাগ মমতাজ বেগমের পক্ষে রায় দেয়। মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা মন্তব্য করেছেন, মুসলিম নর ও নারী যদি স্বামী ও স্ত্রীর পরিচয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করেন এবং তাদের মধ্যে যদি রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও এখানে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলেও গণ্য হতে পারে। সুতরাং কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে।
ভারতের কেরালার একটি পারিবারিক আদালতে এক নারী ভরণ পোষণের দাবিতে মামলা করেন যেখানে বাদীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত পন্থায় এক ছাদের নিচে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করছিলেন তিনি। বিয়ে সম্পর্কিত কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকায় নিম্ন আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। কিন্তু কেরালা হাইকোর্টে বিচারপতি সি এস কারনান এ সিদ্ধান্তকে নাকচ করে বিবাহের সংজ্ঞায় যুগান্তকারী ও যুগোপযোগী এক সিদ্ধান্ত দেন। বলা হয়, আইনে সংজ্ঞায়িত প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে যদি বিবাহপূর্ব কোনো শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হয় এবং একত্রে বসবাস করে সে ক্ষেত্রে এটিকে ‘বিবাহ’ হিসেবে ধরা হবে এবং একত্রে বসবাসকারী ছেলে-মেয়েদের ‘স্বামী-স্ত্রী’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
যদি কোনো অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে যথাক্রমে ২১ এবং ১৮ বছর অতিবাহিত করে এবং একত্রে বসবাস করতে চায়, ‘ফ্রিডম অব চয়েজ’ অনুসারে এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। তবে এই সম্পর্কের সকল পরিণতি বা দায়ও তাদের ওপর বর্তাবে। কারণ কোনো ‘কাজ’ বা ‘আচরণ’ দ্বারা দায়িত্বশীল পক্ষ তার ফলাফল অনুসরণ করবে এটাই স্বাভাবিক।
উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডে স্বীকৃতিমূলক আইনের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েকে বিয়ে ছাড়া একত্রে বসবাস করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এই শর্তে যে তারা যদিও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নয় তথাপি একে অপরের প্রতি দায়িত্ব, ভরণপোষণ, সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ, ব্যক্তিগত ঋণ থেকে উদ্ভুত দায় এড়িয়ে যেতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক আইন যেমন সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১৬, আইসিইএসসিআর-এর ১০ অনুচ্ছেদ, আইসিসিআরপির ২৩ অনুচ্ছেদে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ের কথা বলা হলেও আনুষ্ঠানিকতার উল্লেখ নেই। একই ধরনের অভিব্যক্তি ইউরোপ-আমেরিকার আঞ্চলিক কনভেনশনগুলোতেও দেখা যায়। কিছু দেশীয় আইনে আবার আগ বাড়িয়ে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতাকে এড়িয়ে বলা হয়েছে ‘দুজন ব্যক্তির’ মধ্যে বিয়ে সম্পাদিত হতে পারে (ছেলে-মেয়ের আবশ্যিকতা পরিহার করা হয়েছে)। এ ক্ষেত্রে ২০০৫ সালের কানাডীয় পার্লামেন্টের অনুমোদন উল্লেখ্য। লিভ টুগেদারের মতো আচরণ রোধে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যখন কোনো যুগল এ ধরনের আচরণে জড়িয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে তাদের একপক্ষ যেন অপরপক্ষকে একতরফাভাবে পরিস্থিতির শিকার না বানাতে পারে, সে জন্য আদালত এ ধরনের সম্পর্ককে ‘অনুমান নীতি’র ওপর ভিত্তি করে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও বিয়ে বিবেচনা করতে পারেন। এতে করে পক্ষগণের ওপর দায়-দায়িত্ব আরোপ করা সহজ হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী,আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮