শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন
সিরাজ প্রামাণিকঃ সা’দ আহমেদ ভারতের বিখ্যাত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে স্নাতকে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম, ১৯৪৯ সালে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় এবং একই বছর এল এল. বি’তে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৯ সালে লাক্ষৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইন বিষয়ক আন্ত: বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আন্ত: বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর প্রাচ্যের অক্্রফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজেও স্বল্পকালীন শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৫০ সালে তিনি আইন পেশায় যোগদান করেন। ওই সময় সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী হিসাবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে আইনজীবী হিসেবে তিনি অবিভক্ত কুষ্টিয়া বারে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়ায় ২০০৮ সাল পর্যন্ত আইন পেশায় কর্মরত ছিলেন। প্রচুর লিখেছেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায়। পেশাদারিত্বের ময়দানেও তিনি ছিলেন এক অসাধারণ সাধক।
১৯৭৮ সালে করাচিতে রাবেতা আলম ইসলামীর বিশ্ব সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহর আমন্ত্রণে ইরান সফর করেন এবং ইমাম খোমেনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। ১৯৮০ সাল থেকে বেশ কয়েক বছর ইরানে বিভিন্ন স্থানে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহঃ হযরত মোহাম্মদ (স:) এর দাওয়াত ও আজকের মুসলমান, ইসলামের অর্থনীতি, সূরা আল আছরের আলোকে আমাদের সমাজ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মোহাম্মাদ (স:), ইসলামে মসজিদের ভূমিকা, আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মোহাম্মদুর রসূলুল্লাহ (স), কোরবানীর শিক্ষা, দারিদ্র বিমোচনে জাকাতের ভূমিকা, মুজিবের কারাগারে পৌনে সাত শ দিন (নিষিদ্ধ গ্রন্থ), আমার দেখা সমাজ ও রাজনীতির তিনকাল ইত্যাদি।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনঃ তিনি মুসলিম ছাত্রলীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হোসেন সোহরাওয়ার্দীর আমলে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ষাটের দশকে যাবতীয় আন্দোলন- কপ, পিডিএম, ডাক ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৬৬ হতে ৭৯ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর সাথে আন্দোলন করেছেন। পরে মরহুম মাওলানা আব্দুর রহীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের সাথে কাজ করছিলেন। মাওলানার মৃত্যুর পর তিনি ধীরে ধীরে রাজনীতি বা সাংগঠনিক দিক দিয়ে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশকালীন ঘটনা প্রসংগে তিনি লিখেছেন- …‘আমার মামা শ্বশুর চৌধুরী শামসুদ্দীন আহমদ বাদশা মিয়া’র সংগে(শেখ মুজিবুর রহমান এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল। সেই সুবাদে আমিও আত্মীয়ের আত্মীয় হিসেবে তাদের নিকটবর্তী হলাম। শেখ সাহেবের কথাবার্তা, সৈয়দা’র (সা’দ আহমদের স্ত্রী) প্রতি তার অত্যধিক স্নেহ, আমার প্রতি তার স্নেহমাখা প্রশংসিত দৃষ্টি এবং তার অত্যন্ত খোলামেলা সহজ সরল ব্যবহার আমাদের উভয়ের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু আকর্ষণ সৃষ্টি করল। পরবর্তী আমলে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি, রাজনৈতিক ময়দানে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছি। পরবর্তীতে অনৈক্য সৃষ্টি হয়ে দুই জনের পথ দুই দিক চলে গেছে… । (প্রাগুক্ত পৃ: ৪২)।
১৯৫২ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে (যার নেতা ছিলেন শেখ সাহেব) যোগদান করেন এবং ৫৩ সালের এপ্রিলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীনের কুষ্টিয়া সফরকে কেন্দ্র করে ১৫ দিন কারাবাস করেন। ২য় বার কারাবরণ করেন ১৯৫৯ সালের অক্টোবর মাসে। আর কারামুক্ত হন ১৯৬০ সালের এপ্রিলে। ৩য় বার কারাবাসী হন ৩১ জানুয়ারি ১৯৬২ সালে, মুক্ত হন ৪ মাস পর। এ সময় তিনি আল কুরআনের পূর্ণ তরজমা পড়ার সুযোগ পান। এ পথেই তাঁর চিন্তায় ইসলাম সম্পর্কে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে যোগ দেন জামায়াতে ইসলামীতে। ৪র্থ বার তিনি কারারুদ্ধ হন ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। মুক্ত হয়েছিলেন পৌনে সাত শ’ দিন পর। এ কারাবাসকালেই তিনি রচনা করেন ‘মুজিবের কারাগারে পৌনে সাত শ দিন’ বইটি।
সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডঃ বৃহত্তর কুষ্টিয়া জিলা বোর্ডের নির্বাচিত চেয়ারম্যান, পূর্ব পাকিস্তান সরকারের জুট কর্পোরেশনের ডিরেক্টর, পাকিস্তান ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কর্পোরেমনের ডাইরেক্টর ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয়ভাবে তিনি ছিলেন কয়েক দফা কুষ্টিয়া জামে মসজিদের সম্পাদক, অনেকবার কুষ্টিয়া আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সেক্রেটারিসহ নানা দায়িত্বে। এসব দায়িত্ব পালনে তাঁর সততা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর চরম শত্রুও আমানতদারীর বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেনি।
সা’দ আহমদ’কে নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা-সমালোচনা: সা’দ আহমদ সাহেবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগের তীরটি আমৃত্যু উৎকটভাবে প্রচারিত হত, তা হ’ল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা। এ বিষয়ে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ পেশ হয়। (১) জগতি গ্রামের জনৈক আব্দুস সাত্তারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ ও চুয়াডাঙ্গা আর্মি ক্যাম্পে প্রেরণ দ-বিধি ধারা ৩৬৪ ও দালাল আইন ধারা এ্যাক্ট ১১(খ)। (২) কুষ্টিয়া জেলা সদরে ও বিভিন্ন স্থানে নরহত্যা, অগ্নিসংযোগ, গৃহদাহ, নারী ধর্ষণ ইত্যাদিজনিত অপরাধ সংঘটন দালাল আইন এ্যাক্ট ১১(ঘ), অভিযোগ ৩ Ñদালাল আইন এ্যাক্ট ১১(ক) ধারা ১২১। অভিযোগ ৪Ñ দালাল আইন এ্যাক্ট ২(বি)(৫) যোগে সিডিউল-এর পার্ট (ফোর) (বি) এবং ৫ম অভিযোগÑউক্ত আইনের ২ (বি) (৫) যোগে সিডিউল-এর পার্ট (৪)(বি) এ্যাক্ট ২(ডি)। এসব অভিযোগের জবাবদানে তিনি অপর কোন আইনজীবির সহায়তা দেননি। মামলাগুলোর মধ্যে গুরুতর অভিযোগ প্রথম দু’টি, যা প্রমাণিত হয়নি। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অভিযোগগুলো ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক । এসব অভিযোগে তাঁকে ৩০+৫+৫=৪০ বছর সাজা ঘোষণা, জরিমানা ঘোষণা করে রায় প্রদান করা হয়। আবার বলা হয় শাস্তিগুলো যুগপৎ চলবে। ফলে কম করে হলেও তাঁকে ২১ বছর জেল খাটতে হতো। এ রায় ঘোষণা হয় ১৯৭৩ সালের ১২ মার্চ। বিশেষ ট্রাইবুনালের এ রায়ের মাত্র নয় মাস পর তৎকালীন সরকারের নির্বাহী নির্দেশে তিনি বেকসুর খালাস পান। যে আদেশে বলা হয়েছে দ-বিধির ৩০২, ৪৩৬, ৩৬৪, ৩৭৬, ৩৯৬ ধারা ছাড়া অন্যান্য সমস্ত ধারায় বিচারাধীন বা দ-প্রাপ্ত দালালদের মুক্তি দেবার সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ আদেশবলে তিনি ১৯৭৩ সালের ১১ ডিসেম্বর কারাগার হতে মুক্তি পান।
কিন্তু আইনবিদ সা’দ আহমদ এতে আত্মতৃপ্তি বোধ করে নিশ্চুপ ছিলেন না। এ প্রসংগে তিনি তাঁর স্মৃতিকথামূলক উক্ত বইটিতে উল্লেখ করেছেন- ‘….পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে কুষ্টিয়ার দায়রা জজ ও স্পেশাল ট্রাইবুনাল মি.আর.কে. বিশ্বাস আমাকে বিভিন্ন ধারায় ১২-৩-৭৩ তারিখে ৩০ বছরের কারাদ- ও জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর কারাদ- প্রদান করেন। একই সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দিলেও হাইকোর্ট ডিভিশনে আমার দাখিলকৃত আপীল মোকদ্দমা আমি প্রত্যাহার করি নাই। যদিও মোকদ্দমাটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং শাস্তির মাত্র কয়েকমাস পর বাংলাদেশ সরকার আমাকে মুক্ত করে দেয় তবুও এই রায়কে আমি কখনও ন্যায়সঙ্গত বলে গ্রহণ করতে পারি নাই। এজন্য উচ্চ আদালতের দরজায় নাড়া দিয়ে আমি এই রায়ের যথার্থতা পরখ করতে চেয়েছিলাম। মহামান্য বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি মোস্তফা কামালের আদালতে ১৯৮১ সালের ২৯ অক্টোবর ও ২রা নভেম্বর শুনানী হয় এবং ৩রা নভেম্বর রায় ঘোষণা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশনে আমার আপীলের শুনানী আমি নিজেই করি এবং আমাকে সাহায্য করেন আমার ছোট ভাইতুল্য এটি চৌধুরী ও এ্যাডভোকেট আনসার আলি। ৩ দিনের একটানা শুনানীতে নি¤œ আদালতের রায়সহ যাবতীয় বিষয়াদি পুংখানুপুংখরূপে মহামান্য বিচারপতিদ্বয়ের সম্মুখে আমি তুলে ধরার সুযোগ পাই এবং রায়ের অন্তসারশূন্যতা প্রমাণের চেষ্টা করি। মহামান্য বিচারপতিদ্বয় ৩রা নভেম্বর তাঁদের সুচিন্তিত ও সুলিখিত রায় প্রদান করেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, সা’দ আহমদ কোনদিন রাজাকার ছিলেন না। রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না বা তিনি রাজাকার বাহিনী পরিচালনা করেন নাই। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ ঘোষণা করেন নাই বা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন নাই, বা সহযোগিতা করেন নাই, পিস কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে কোন অন্যায় করেন নাই, বরং ক্ষতিগ্রস্থ জনগণের মধ্যে ত্রাণ ও সাহায্য প্রদান করেছেন .. ..”। ৩৫ ডিএল আর ৪১, ৩ বি এল ডি ৭৫ এবং বি.সি. আর.৩৯৩ পৃষ্ঠায় এই রায় প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সা’দ আহমদ সাহেব সে অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলেন। আদালত তাঁর পক্ষে রায় দেন।
এ্যাডভোকেট সা ’দ আহমেদ ১৯২৭ সালের ১ মে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম ডা. মনির উদ্দিন আহমেদ ও মা মরহুমা হালিমা বেগম। তিনি ২০১৫ সালে প্রায় ৯০ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। তার সন্তানগণ নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮