শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
সমকামিতা বলতে সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি রোমান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ অথবা যৌন আচরণকে বোঝায়। যৌন অভিমুখীতা হিসেবে সমকামিতা বলতে বোঝায় মূলত সমলিঙ্গের ব্যক্তির প্রতি আবেগীয়, রোমান্টিক যৌন আকর্ষণের একটি স্থায়ী কাঠামোবিন্যাস।
এবার সমকামিতা নিয়ে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন ভারতের শীর্ষ আদালত। ৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সমকামিতাকে বৈধতা দিয়ে রায় প্রকাশ করেন। অতীতে ভারতে সমকামিতাকে অপরাধ বলেই গণ্য করা হত। ভারতীয় দ-বিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী যদি একই লিঙ্গের মানুষ যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের যাবজ্জীবন বা ১০ বছর পর্যন্ত জেল জরিমানার হতে পারে। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল এই আইন। ২০০৯ সালে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল ভারতীয় দ-বিধির ৩৭৭ নম্বর ধারা সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করছে।এবার শীর্ষ আদালত সেই সুরে জানিয়ে দিলেন, ৩৭৭ ধারায় সমকামিতার অধিকার খর্ব করা অযৌক্তিক এবং অপ্রাসঙ্গিক। দু’জন সমলিঙ্গের মানুষ যদি ব্যক্তিগত পরিসরে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে তা কোনও অপরাধ নয়।
পাঠক এবার আসল কথায় আসি। সারা পৃথিবীতে সমকামী, বিকৃত যৌনাচার, সমমৈথুন, পশুমৈথুন নিয়ে আন্দোলন চলছে, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক চলছে, চলতে থাকবে। বাংলাদেশ দন্ড বিধির ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কোন পুরুষ, নারী বা জন্তুর সহিত প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যৌন সহবাস করে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদ-ে বা যেকোন বর্ণনার কারাদ-ে-যার মেয়াদ দশ বছর পর্যন্ত হতে পারে-দন্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদ-েও দ-নীয় হবে।
এ ধারায় সম্মতিক্রমে অস্বাভাবিক বা বিকৃত যৌনাচার করলেও অপরাধ হবে। এখানে সম্মতির কোন মূল্য নেই। কেউ স্ত্রীর সাথে সহবাসের সময় যোনীপথ ব্যতিত অন্য কোনভাবে যা গুহ্যদ্বার, মুখের মধ্যে বা অন্য কোন মাধ্যমে সংগম অন্তে বীর্যপাত করলে এ ধারার আওতাধীন অপরাধ হবে।
সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বাধ্য এবং ২৬ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন আপনা আপনি বাতিল বলে গন্য হবে। একই সাথে, ২৬ (২)অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করবে না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হলে তা বাতিল হয়ে যাবে। তাছাড়া, ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী বলে ঘোষনা করেছে।
আমাদের পবিত্র ও মহান সংবিধানে সকল প্রকার বৈষম্যহীন উল্লেখিত অধিকার সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হলেও বাস্তবে আমরা তার প্রতিফলন দেখি না। বিশেষত যৌন প্রবৃত্তিগত সংখ্যালঘু ব্যক্তি সর্বদা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হয়। এমন কি দেশের প্রচলিত আইন দ্বারাও তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়।
আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে দুজন পুরুষ ও মহিলা ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সম্মতি ব্যতীত, ভয় দেখিয়ে বা প্রলোভনের দ্বারা সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে অথবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন মহিলাকে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতীত যৌন সহবাস করে তবে তা দ-নীয় অপরাধ হিসেবে গন্য হয়। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন পুরুষ ও মহিলা কোন প্রকার প্রলোভন ও ভয়ভীতি ছাড়া স্বেচ্ছায় জনসম্মুখের অগোচরে বেশ্যাবৃত্তির উদ্দেশ্য ব্যতীত যৌন সহবাস করে তবে তা অপরাধ নয়।
সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১ ধারায় সকল মানুষ স্বাধীন এবং সম মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে বলে ঘোষনা করা হয়েছে। ফলে লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার (এলজিবিটি) সহ সকল মানুষ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী জীবনের অধিকার; ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার; স্বেচ্ছাচারী আটক, গ্রেফতার ও নির্যাতিত না হওয়ার অধিকার; মত প্রকাশ, সংগঠন করা ও শান্তিপূর্ন সমাবেশের অধিকারসহ একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সহজাত সকল অধিকার পূর্ণরুপে উপভোগ করার অধিকারী।
বাংলাদেশে সমকামিতার কোন বৈধতা নেই। তবে প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় বিলাসবহুল বাসা ভাড়া নিয়ে এক শ্রেণীর পুরুষ অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনসর্ম্পক স্থাপন করছে। একইভাবে নারীরাও সমকামী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। নারীতে নারী সমকামী সম্পর্ক গভীর হচ্ছে।
২০১৩ সালে দুই সমকামী নারীর বিয়ে নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে চলে ব্যাপক সমালোচনা। দুই নারীর বিয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই আরও একটি ঘটনা নজরে আসে। মোহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান ও মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম নামের দুই যুবকের সমকামী সম্পর্ক নিয়ে চারদিকে শুরু হয় তোলপাড়। এদের দুজনকে সবাই বন্ধু হিসেবেই জানতেন। তারা রাজধানীর ভাটারা থানার জোয়ার সাহারা এলাকার ক-১৪১/৪ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। হিযবুত তাহরীর নামের নিষিদ্ধ একটি সংগঠন এক চিঠিতে তাদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়। তারপর বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।
এদিকে, আইনী প্রতিবন্ধকতা থাকায় দেশে ঠিক কতো সংখ্যক সমকামী রয়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে সমকামীদের পক্ষেও কোন কোন সংগঠন কথা বলছে। নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা বিভিন্ন ফোরামে কথা বলছে। আর সমকামিতার বিপক্ষে সোচ্চার দেশের ইসলামিক দলগুলো। তাদের মতে এ ধরণের সম্পর্ক শুধু অনৈতিকই নয়; প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সামাজিক সম্পর্ক ভেঙে দেয়ার চক্রান্তও।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই সমকামী বিয়ে বৈধ। প্রায় ২০ টি দেশে সমকামী বিয়ের বৈধতা রয়েছে। তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০০৩ সালে বেলজিয়াম, ২০০৫ সালে স্পেনে, ২০০৯ সালে নরওয়ে, একই বছর সুইডেন, ২০১০ সালে পর্তুগাল, একই সময়ে আইসল্যান্ড, ২০১২ সালে ডেনমার্ক ও সর্বশেষ ২০১৪ সালে ফিনল্যান্ডে সমকামী বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, লুক্সেমবুর্গ, আয়ারল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র ও নিউজিল্যান্ডসহ অন্তত ২০ টি দেশে সমকামীদের অধিকার সুরক্ষায় আইন আছে। তবে সমকামী বিয়ের বৈধতার তালিকায় এশিয়ার কোন দেশ নেই। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ এবার ভারতেও সমকামিতা বৈধতা দিল। আমরা অনেক কিছুই ওদের অনুসরণ, অনুকরণ করি-অনেকটা বাধ্য হয়েই। দূর ভবিষ্যতে কি কোনো অশুভ সংকেত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে?
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮