সিরাজ প্রামাণিক: কুষ্টিয়ার আইনজীবী আলহাজ্ব মরহুম আব্দুর রহিম ছিলেন একজন স্বনামধন্য বাংলাদেশী আইনবিদ, আইন সংস্কারক, বাগ্মী, ভাষাবিদ, জাতীয় সাংসদ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
কর্মজীবনেও তিনি ছিলেন সমাজ নীতি, ধর্মনীতি, দর্শন সহ বিভিন্ন অঙ্গনে অসম্ভব প্রতিভাময়ী ও বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী। অসম্ভব ধৈর্য্য আর সহনশীল ছিলেন তিনি। জীবনে তিনি কোন কিছুকেই প্রতিবন্ধকতা মনে করেননি। শিক্ষা জীবন থেকে তিনি সরাসরি নেমে পড়েন কর্মজীবনে। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন। ১৯৪৫ সালে মুর্শিদাবাদ সরকারী স্কুলে তিনি ইংরেজী শিক্ষক হিসাবে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তিনি অত্যধিক মেধাবী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব হওয়ায় ওই সময়ে স্কুল পরিদর্শকের চাকুরী পান। কিন্তু তিনি চাকুরীতে যোগদান করেন নাই। ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে ভেড়ামাড়া হাইস্কুলে রেক্টর হিসেবে কিছুদিন চাকুরী করেন। ১৯৪৯ সালে কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ নিয়ে আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
শিক্ষা জীবনেও এ্যাডঃ আব্দুর রহিম অত্যন্ত কৃতিত্বের এবং মেধার সাক্ষর রেখেছিলেন। পৈত্রিক নিবাস কয়া ইউনিয়নের সুলতানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু করেন প্রাথমিক শিক্ষা জীবন। ১৯৩৩ সালে সুলতানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেনী থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় তৎকালীন নদীয়া জেলার মধ্যে তিনি ২য় স্থান অধিকার করেন। প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করে ভর্তি হন তৎকালীন ইউনাইটেড হাই স্কুলে [বর্তমানে কুষ্টিয়া হাই স্কুল]। ১৯৩৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ষ্ট্যান্ড করেন। ১৯৪০ সালে কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে তিনি ২য় বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি একই কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাশ করেন ১৯৪৩-১৯৪৪ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিটি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৪৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি কুষ্টিয়ার আরেক স্বনামধন্য আইনজীবী এডভোকেট মাহাতাব উদ্দিনের জুনিয়র হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেই থেকেই আমৃত্যু সফলতার সঙ্গে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় কুষ্টিয়া আদারতে জি,পি ও পি,পি এর দায়িত্ব সুনামের সঙ্গে পালন করেছেন। তিনি ঢাকা ল কলেজের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এ্যাডঃ আব্দুর রহিম সাহেব ১০ বারেরও অধিক সময় কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিরও একজন সদস্য ছিলেন। এডঃ আব্দুর রহিম ৫০ বছরের অধিক সময় আইন পেশায় নিয়োজিত থাকার জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিল তাকে ২০০০ সালে ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে সম্মাননা ও ক্রেস্ট প্রদান করেন। কুষ্টিয়া জেলা আইনজীবী সমিতির তিনি ছিলেন সর্বজৈষ্ঠ ও বটবৃক্ষসম ব্যক্তিত্ত্ব।
এ্যাড: আব্দুর রহিম সাহেবের রাজনৈতিক জীবন ছিল অত্যন্ত সফল। বিচিত্র জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তিনি ছিলেন একজন রীতিরকম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক জীবনের পদচারণা শুরু করেন ১৯৬২ সালে। সে সময়ের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নিতে তিনি পাকিস্তান সফর করেন।
মুসলিমলীগ থেকে পদত্যাগ করে শেখ মুজিবের ৬ দফায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তার বাড়ীতে ৬ দফার কার্যক্রমের অস্থায়ী অফিস হিসাবে কাজ হয়। কুষ্টিয়ার বাড়ীতে তৎকালীন ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, শেখ শহিদুল ইসলাম, মনিরুল চৌধুরী, জিন্নাত আলী, কাজী আরেফ, হাসানুল হক ইনু সহ অনেক ছাত্র নেতা থাকা খাওয়া করেছেন। উনার বাসায় ছাত্রলীগের প্রায়ই সভা হতো। স্থানীয় ছাত্র নেতা যেমন - শেখ দলিল, মারফত আলী, সামসুল হাদী, বাহাউদ্দীন, আখতারুজ্জামান মাসুম, মুর্শেদ আলম মধু, জাহিদ হোসেন, আব্দুল হান্নান, ফজলুল হক, সামসুল বারী, ইয়াকুব আলী, গাংনীর মহিউদ্দিন, জহরুল ইসলাম, মির্জা জিয়াউল বারী নোমান, শহিদুল ইসলাম কিসলু, আব্দুল বারী, নুর আলম জিকু, আক্কাস আলী মঞ্জু, সামছুল হুদা, আব্দুল জলিল সহ অনেকেই প্রায়ই সভা করে ৬ দফা তথা ১ দফা আন্দোলনের গোপন বৈঠক করতো।
৬৯ এর গন আন্দোলনের গোপন বৈঠকের স্থানই ছিলো উনার বাড়ী। যার কারনে প্রায়ই পুলিশ হানা দিত। ছাত্রনেতা আব্দুল মোমেন উক্ত বাড়ীতে থাকতেন এবং সেখান থেকে ছাত্ররাজনীতি করার জন্য উৎসাহ দিতেন যার জন্য উনাকে প্রশাসন দ্বারা অপদস্থ হতে হয়েছে। পিপি থাকার কারনে কুষ্টিয়ার অনেক নেতাকে সেই সময় গ্রেফতার হতে হয়নি।
এরপর ১৯৭৯ সালে তিনি বি,এন,পি র প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান। ওই বৎসরে তিনি কুষ্টিয়ায় বি,এন,পি র নির্বাচিত সাংসদ হন। তিনি সাংসদ থাকাকালীন সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে জাপান সফর করেন। আব্দুর রহিম সাহেব কুষ্টিয়ার মৌলভী আফসার উদ্দীন, জেহের মন্ডল সহ কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রিয়ভাজন ছিলেন।
জনাব আব্দুর রহিম সাহেব ছিলেন একজন দয়ালু ব্যক্তি। কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা আদালতে তার প্রচুর চাহিদা ছিলো। কিন্তু দিন শেষে যখন বাড়ী ফিরতেন তখন তার পকেট প্রায় শুন্য হয়ে যেত। তিনি যখন বাড়ী যাওয়ার জন্য রিকশায় উঠতেন, তখন ১৫/২০ জন গরীব মিসকিন তাকে ঘিরে ধরত। তিনি সবাইকেই সাধ্যমত টাকা দিতেন। অনেক মহুরী ও জুনিয়র এডভোকেট তার নামে কেস নিয়ে তাকে দিয়ে কেস লড়াতেন এবং তিনি তাদের সবাইকে খুশি করতেন। গরীব, অসহায়, দুস্থ মানুষের বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা দিতেন।
তিনি সমাজের নানা উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ছিল অনস্বীকার্য। কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়ক নির্মাণ, কুষ্টিয়া চাদ সুলতানা বালিকা বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ, কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ, ইত্যাদি প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রনী ভুমিকা পালন করেন। তিনি কুষ্টিয়া ল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক। কুষ্টিয়া মুসলিম হাই স্কুল, মোহিনী মোহন বিদ্যাপিঠ, কুষ্টিয়া হাই স্কুল, সুলতানপুর মাহতাবিয়া স্কুল, কুষ্টিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, আফসার উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিনি সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক ছিলেন। কুষ্টিয়া কোর্ট ষ্টেশন জামে মসজিদের ও হোসেনিয়া ও আব্দুল করিম দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের গভর্নিং কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ২০০১ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করেন।
১৯২১ সালে কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের বাড়াদী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন তিনি। তাঁর পিতা মরহুম মুন্সী হোসেন আলী ছিলেন পেশায় একজন গৃহস্থ। পারিবারিক জীবনে রহিম সাহেব একেবারে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও কুষ্টিয়া জজ কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, seraj.pramanik@gmail.com
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com