শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: একটি আত্মহত্যা, সুইসাইড নোট, ফেসবুক বন্ধুদের আবেগী বক্তব্য, স্থানীয় সাংবাদিকদের বিশেষণ মিশ্রিত সংবাদ দিনভর আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, খোকসায় চায়ের দোকান থেকে সচেতন পরিবারের মধ্যে। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।
‘সুইসাইড নোট’ এই সময়ের আলোচিত বিষয়। যখন কোনো ব্যক্তি তার মৃত্যুর পূর্বে মৃত্যুর কারণ সংবলিত কোনো বক্তব্য লিখে যান, ওই বক্তব্যকেই সুইসাইড নোট বলে। এর সাথে সম্পৃক্ত থাকে মৃত্যুতে সহযোগিতা বা আত্মহত্যার প্ররোচনা। তবে সহযোগী বা প্ররোচনার বিষয়টি প্রমাণের দাবি রাখে।
বাংলাদেশে প্রচলিত সাক্ষ্য আইন-১৮৭২ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী উক্ত সুইসাইড নোট প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য হবে। তবে শুধুমাত্র একটি সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। যখন উক্ত সুইসাইড নোটের সমর্থনে অপরাপর সাক্ষ্য উপস্থাপন এর মাধ্যমে কারো বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ সন্দেহের বহির্ভূতভাবে প্রমাণিত হবে তখনই শাস্তি প্রদান করা যাবে। কারণ ফৌজদারি মামলা ১০০% প্রমাণ করতে হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মহত্যা কবিরা গুনাহ, শিরকের পর সবচেয়ে বড় গুনাহ। কারণ, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। আর এই মৃত্যু দান করেন একমাত্র তিনিই। তিনি ছাড়া কেউ কাউকে মৃত্যু দিতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে।’ [সূরা ইউনুস, আয়াত ৫৬]
বাংলদেশ দ-বিধি, ১৮৬০ এর ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির আত্মহত্যায় প্ররোচনার শাস্তি ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং জরিমানা। তবে আত্মহত্যা করতে গিয়ে না মরলে আপনাকে আত্মহত্যা বা নিজেকে ধ্বংস করার অপচেষ্টার অপরাধে ১ বছরের জেলে যেতে হতে পারে। দন্ড বিধির ৩০৯ ধারা মতে, যদি আপনি আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নেন এবং অনুরুপ অপরাধ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করেন তাহলে আপনার ১ বছর পযর্ন্ত কারাদ- বা জরিমানা হতে পারে। বা উভয় শাস্তিই হতে পারে।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
(পূনশ্চ: অসুস্থ আপন খালাকে দেখতে কুষ্টিয়া জেলা শহরে যাওয়ার জন্য গত শুক্রবার বিকালে মামার শ্বশুর শাহীনের মোটর সাইকেলে রওনা হয় সুমাইয়া । এ সময় শাহীন ওই ছাত্রীকে কৌশলে পদ্মা নদীর চরে নিয়ে যায়। সেখানে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে শাহীন নিজেই ছাত্রীটিকে তার বাড়িতে দিয়ে যায়)
মোটকথা, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যখন জেনে-বুঝে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেন তখন পরবর্তীতে সেই সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে আদালতের কাছে প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের দায়ে প্রতারণার মামলা চলতে পারে। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে। কারণ এই বয়সী মেয়ে সম্মতি দেয়ার মতো সক্ষমতা রাখে না বলে আইন মনে করে। তবে এ গল্পে সুমাইয়ার বয়স হবে ২০ এর অধিক।
আরেকটি বিষয়, কোনো নারীর সম্মতি ছাড়া বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কাজ দ্বারা সম্ভ্রমহানি হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারী আত্মহত্যা করলে তা আত্মহত্যা করতে প্ররোচনার অপরাধ হবে। যার জন্য সে ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদন্ড হবে নারী ও শিশু আইন, ২০০৩ মতে।
তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সুইসাইড নোট দেখে তথ্য জোগাড়ের সময় সাবধান থাকা জরুরি। কারণ, ১৫-২০ শতাংশ সুইসাইড নোটে ভুয়া তথ্য দেওয়া থাকে।
ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো সাক্ষী প্রমান দ্বারা আসামী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আসামীকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে। তাকে দোষী বলে কোনো বক্তব্য প্রকাশ করা যাবে না। (২২ ডিএলআর, ৩১, অ্যাপিল্যাড ডিভিশন)।
২০০০ সালে প্রণীত আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ ধারায় নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশে বাঁধা-নিষেধ রয়েছে। ১৪(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, নারী নির্যাতন সংক্রান্ত সংবাদ এমনভাবে ছাপাতে হবে, যাতে ওই নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়। ১৪ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সংবাদপত্রে নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় ছাপানো হয়, তবে তার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের প্রত্যেকে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা তিনি বা তারা উভয়দণ্ডে দন্ডিত হতে পারেন। (ফেসবুক বন্ধুরা সাবধান)