বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫০ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ ১৯৯৩ সালের ১১ জুলাই। এই দিনটি অভিশাপ হয়ে এসেছিল যুবক ফজলু মিয়ার জীবনে। পুলিশের সন্দেহের কারণে তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ২২টি বছর। ২০১৬ সালে তাঁর মুক্তি মিলেছে বটে, কিন্তু তিনি কি আর ফিরে পাবেন সেই স্বপ্নময় জীবন?
সিলেটের আদালত পাড়ায় ঘোরাঘুরি করার সময় পুলিশের একজন ট্রাফিক সার্জেন্টের সন্দেহের শিকার হন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার তেতলি ইউনিয়নের ধরাধরপুর গ্রামের দরিদ্র ফজলু মিয়া। এরপর তাঁকে সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ফজলুর বিরুদ্ধে পাগল আইনে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। সেই থেকে তিনি কারাগারেই ছিলেন।
ফজলু মিয়া যখন গ্রেপ্তার হন তখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ২৭-২৮ বছর। এখন তাঁর বয়স ৫০ পেরিয়েছে। শরীর ভেঙে গেছে। ঠিকমতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না। কথাও জড়িয়ে যায় মুখে। অতীতের কিছুই যেন তাঁর মনে নেই। অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন হারিয়ে ফেলেছে ফজলু।
ফজলু ওই গ্রামের সৈয়দ গোলাম মাওলার ছেলে। তিনি কারাগারে যাওয়ার পর তাঁর মা-বাবা দুজনই মারা যান। পরিবারের আর কেউ নেই। তিনি বিয়ে করেননি, সংসার হয়নি তাঁর। এই ২২ বছর তাঁকে কেউ কারাগারে দেখতে আসেনি। কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিয়েছেন গুনে গুনে ১৯৭ দিন। সেই আদালতপাড়ায়ও দেখা হয়নি তাঁর কোনো স্বজনের সঙ্গে।
পরে ২০০২ সালে ফজলুকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। আদালত থেকে আদেশ পেয়ে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে মুক্তি দেন। কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীন এই ব্যক্তিকে নিতে কেউ আসেননি। ফলে তাঁকে আবারও নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে। এরপর কেটে গেছে আরো ১৩ বছর। কিন্তু রাষ্ট্র সেই দায়িত্বটুকু পালন করতে পারেনি।
একসময় ফজলুর এই বিভীষিকাময় জীবনের কথা গণমাধ্যমে উঠে আসে। ফলাও করে প্রচার হয় ফজলু মিয়ার করুণ কাহিনী। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। কিন্তু তারপরও আইনের মারপ্যাঁচে কেটে যায় আরো ১০ বছর।
আমাদের সাংবিধানিক অধিকার হলো কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনারকর দন্ড দেয়া যাবে না কিংবা কারো সঙ্গে কোনোরুপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনানুযায়ী ছাড়া জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না কিংবা কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এমন কাজ করা যাবে না। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। পাঠকের কাছে প্রশ্ন, সে সংবিধান লংঘন করে পুলিশ কি কাউকে বিনা দোষে গ্রেফতার করতে পারে, মারধর করার অধিকার রাখে? মনে রাখা দরকার, কোনো ব্যক্তিকে থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদকালে তদন্ত বা রিমান্ডের নামে পুলিশের মারধর করা সম্পূর্ণ বেআইনি। অর্থাৎ পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশি হেফাজতে থাকাকালে কাউকে অযথা মারধর করতে পারে না। তবে কিছু কিছু বিষয় ব্যতিক্রম রয়েছে, যেমন-
১. কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ বাঁধার সম্মুখীন হলে বা আসামী পলায়ন করলে, আসামীকে ধরা বা পলায়ন রোধের জন্য যতোটুকু বল প্রয়োগ করা প্রয়োজন, ঠিক ততোটুকু বল প্রয়োগ করতে পারে।
২. দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আক্রমণের শিকার হলেও পুলিশ বল প্রয়োগ করতে পারে।
৩. শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশ কোনো বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্যও বল প্রয়োগ করতে পারে।
তবে স্বেচ্ছায় কোনো আত্মসমর্পণকারী বা শান্ত অপরাধীকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ বল প্রয়োগ করতে পারে না।
কখন পুলিশ কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারে
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের নির্বিচারে গ্রেপ্তারের যে ক্ষমতা পুলিশের উপর অর্পণ করা হয়েছে, তা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী, এর প্রয়োগও ব্যক্তি স্বাধীনতায় আঘাত হানার শামিল। বলা বাহুল্য, শতবর্ষ আগে এই আইনের জন্ম হয়েছিল জনকল্যাণে নয়, বরং নির্দয় একটি আইন হিসেবে ঔপনিবেশিকতার স্বার্থসিদ্ধির প্রেক্ষাপটে। শতবর্ষের বেশী হলেও এই নির্দয় একটি আইনের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যেকোনো পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ বা পরোয়ানা ছাড়াই যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারেন।’ ৯টি কারণে এ ধারায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে।
প্রথমত. কোনো আমলযোগ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি এরূপ জড়িত যে, তার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ ও সন্দেহ রয়েছে অথবা বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গিয়েছে।
দ্বিতীয়ত. আইনসঙ্গত কারণ ব্যতীত যার নিকট ঘর ভাঙার কোনো সরঞ্জাম রয়েছে। এ আইনসঙ্গত কারণ প্রমাণ করার দায়িত্ব তার।
তৃতীয়ত. এ কার্যবিধি অনুসারে অথবা সরকারের আদেশ দ্বারা যাকে অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে।
চতুর্থ. পুলিশ অফিসারকে তার কাজে বাঁধাদানকারী ব্যক্তি অথবা যে ব্যক্তি আইনসঙ্গত হেফাজত থেকে পলায়ন করেছে।
পঞ্চমত. বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী থেকে পলায়নকারী ব্যক্তি। যাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে।
ষষ্ঠত. চোরাই বলে যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যেতে পারে। এরূপ মাল যার নিকট রয়েছে এবং এরূপ মাল সম্পর্কে কোনো অপরাধ করেছে বলে যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যায়।
সপ্তমত. এমন অপরাধ যা বাংলাদেশে করা হলে শাস্তিযোগ্য হতো। বাংলাদেশের বাইরে এরূপ কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ, সন্দেহ এবং বিশ্বাসযোগ্য খবর পাওয়া গিয়েছে। যার জন্য সে প্রত্যার্পণ সম্পর্কিত কোনো আইন অথবা ১৮৮১ সালের পলাতক অপরাধী আইন অনুসারে অথবা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হতে বাধ্য।
অষ্টমত. কোনো মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী মুক্তির পর বাসস্থান বা বাসস্থান পরিবর্তন বা বাসস্থান থেকে অনুপস্থিতির বিজ্ঞপ্তিকরণ সম্পর্কে সরকার কর্তৃক প্রণীত কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করলে।
নবমত. কাউকে গ্রেপ্তারের জন্য অন্য কোনো পুলিশ অফিসারের নিকট থেকে অনুরোধ পাওয়া গেছে এবং তার অপরাধ ও গ্রেপ্তারের কারণ প্রেরণ করা হয়েছে। সেই অফিসার ওই ব্যক্তিকে আইনসঙ্গতভাবে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন।
সবসময় লক্ষণীয় যে, উপরোক্ত কারনে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় কোন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশকে যুক্তিসঙ্গতভাবে যতোটুকু বল প্রয়োগ করা প্রয়োজন, ঠিক ততোটুকুই করবে। অযৌক্তিক বল প্রয়োগ বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী। গ্রেপ্তারের পর সংবিধান অনুযায়ী সবার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার অধিকার আছে। সে ক্ষেত্রে আসামী পক্ষ কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন আইনজীবীর করণীয় :
১.আইনসঙ্গত যে কোনো উপায়ে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে থানা থেকে মুক্ত করার পদক্ষেপ নেয়া।
২. থানা থেকে মুক্ত করা সম্ভব না হলে দ্রুত এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিষ্ট্রেট বা সংশ্লিষ্ট কোর্টে গিয়ে জামিনের জন্য আবেদন করা।
৩. তাও যদি সম্ভব না হয়, তবে পর্যায়ক্রমে জেলা জজ কোর্ট বা হাইকোর্ট বিভাগে জামিনের আবেদন করা। মনে রাখতে হবে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির জামিন পাওয়া নির্ভর করে তাকে কোন আইনে এবং কী অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে এর ওপর। সর্বোপরি কাউকে জামিনে মুক্তি দেয়া বা না দেয়া আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির যা আইনগত অধিকার
পুলিশ অথবা গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রাখেন এমন কেউ যখন আপনাকে ওয়ারেন্ট ছাড়া বা ওয়ারেন্টসহ আটক করবেন, তখন আপনি গ্রেপ্তার হয়েছেন কি- না, সে ব্যাপারে জানতে চাইবেন। আপনার বিরুদ্ধে যদি কোনো ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়, তবে ওই ব্যক্তি ওয়ারেন্টের বিষয় সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করবেন এবং প্রয়োজনে তা দেখাতে বাধ্য থাকবেন। আপনি নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা এবং পরিচয় দেওয়ার পরও যদি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম না হন, তাহলে আপনাকে সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে মুক্তি লাভের জন্য সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। পুলিশের তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে আপনার পরিচয় দেবেন। বেশি জোরাজুরি করলে বলবেন, আমি সবকিছু আদালতে বলব। কারণ নাম-ঠিকানা বাদে কোনো কিছুই পুলিশকে বলতে আপনি বাধ্য নন। আদালতে বলা আপনার অধিকার। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সর্বপ্রথম যা করতে হবে, তা হলো পুলিশের কাছে আপনাকে গ্রেপ্তারের কারণ জানতে চাইবেন। পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে বাধ্য। এরপর যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ কোনো পরিচিতকে গ্রেপ্তারের ঘটনা জানান কিংবা আপনার কাছে মুঠোফোন থাকলে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত আইনজীবী নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে বলুন। সম্ভব হলে আপনার আইজীবীর সঙ্গে সরাসরি মুঠোফোনে যোগাযোগ করুন। গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে নিকটস্থ থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। আপনাকে থানায় নেওয়ার পর যেখানে আটক রাখা হবে, সেখানে আপনি আপনার পরিধেয় বস্ত্র বাদে আর কিছুই নিতে পারবেন না। তাই গ্রেপ্তার হওয়ার সময় যা যা আপনার সঙ্গে ছিল, তা যখন পুলিশ নিয়ে যাবে, তখন সেগুলোর বিবরণ খাতায় লিপিবদ্ধ করার সময় কিছু বাদ দিল কি না, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। নিশ্চিত হওয়ার পর খাতায় স্বাক্ষর করবেন। থানায় নেওয়ার পর পুলিশ আপনাকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে জেরা করবে আর আপনার বিবৃতি দিয়েই আপনাকে অপরাধী বানানোর একটা অপচেষ্টা পুলিশ চালাতে পারে। তাই পুলিশের জেরার মুখে মাথা ঠান্ডা রাখুন আর যে কোনো প্রশ্নের জবাব, যা আপনাকে অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত করবে, তা প্রদান করা থেকে বিরত থাকুন। পুলিশের কাছে আপনি যা বলবেন, তা তারা লিখে নেবে। তাই লিপিবদ্ধ করার পর পুলিশকে তা পড়ে শোনাতে অনুরোধ করুন। আর কিছু বলে ফেললেও তা কিন্তু সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে গণ্য হবে না। আপনার যা কিছু বলার তা আদালতে আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে বলুন। এটা আপনার অধিকার।
গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে নিকটস্থ ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। এর অধিককাল পুলিশ আপনাকে আটকে রাখতে পারবে না। এটা আপনার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। ২৪ ঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোনো অবস্থাতেই (ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ ছাড়া) পুলিশ আপনাকে আটক রাখতে পারবে না। এই সময় পার হয়ে গেলে পুলিশ আপনাকে অবশ্যই রিমান্ডের প্রার্থণা করে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাবে। ম্যাজিষ্ট্রেট আপনাকে জামিনে ছেড়ে দেবেন অথবা রিমান্ড মঞ্জুর করবেন কিংবা রিমান্ড মঞ্জুর না করেই জেলখানায় পাঠিয়ে দিতে পারেন। আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যদি জামিনযোগ্য হয়, তাহলে জামিনপ্রাপ্তি আপনার অধিকার। তাই আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো জামিনযোগ্য কি-না, তা যাচাইয়ের জন্য ফৌজদারী কার্যবিধির দ্বিতীয় তফসিলের ৫ নম্বর কলামটি দেখুন অথবা এ বিষয়ে আপনার আইজীবীকে সতর্ক হতে বলুন। অভিযোগের কারণ গুরুতর অথবা জামিনযোগ্য না হলে আপনি জামিন না-ও পেতে পারেন। তবে জামিন পাওয়ার জন্য আইনজীবীর মাধ্যমে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, আপনাকে জামিন নিতে হলে জিম্মাদার লাগবে, সঙ্গে লাগবে টাকা। তাই এ দুটোর ব্যবস্থা করতে যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব আইনজীবী নিয়োগ করুন। আপনার সামর্থ্য না থাকলে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পেতে আবেদন জানান। আর যদি সামর্থ্য থাকার পরও যোগাযোগ করতে পারছেন না এমন হয়, তাহলে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে সহায়তার জন্য সাহায্য চান। আপনাকে যদি থানায় অত্যাচার করা হয়ে থাকে, তাহলে তা ম্যাজিষ্ট্রেটকে জানান এবং আপনাকে চিকিৎসা প্রদানের জন্য অনুরোধ করুন। তাই পুলিশ যদি এই অধিকারগুলো লঙ্ঘন করে, তাহলে আপনি আপনার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে হাইকোর্ট বিভাগে রিট করতে পারেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ নম্বর ধারা এবং পুলিশ রিমান্ড-সংক্রান্ত ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ নম্বর ধারা সংশোধন করার জন্য একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন এবং এই দুটি ক্ষেত্রে সরকারকে কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা মেনে চলার জন্যও হাইকোর্ট অভিমত দিয়েছেন। সম্প্রতি আপীল বিভাগও হাইকোর্টের দেয়া ওই রায় বহাল রেখেছেন।
উচ্চ আদালতের অভিমত ও নির্দেশনা
পাঠক নিশ্চয়ই রুবেলকে পিটিয়ে হত্যার কথা সবার মনে আছে। শামীম রেজা রুবেল ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁকে নির্যাতন করা হয়। মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে মারা যান রুবেল। রুবেলের মৃত্যুর ঘটনা তখন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সরকার এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। হত্যার অভিযোগে ওইসব পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। অন্যদিকে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। ওই বছরের ২৯ নভেম্বর আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এ ব্যাপারে কয়েক দফা নির্দেশনা ও সুপারিশ দিয়ে রায় দেন। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরামহীন প্রচেষ্টার পরও সরকার আজ পর্যন্ত ওই রায়ের আলোকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি কিংবা করতে পারেননি। ২০১৬ সালে এপ্রিল মাস থেকে আপীল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া ওই রায়, অভিমত ও নির্দেশনা বহাল রেখেছেন। উল্লিখিত রায়ে ৫৪ ধারার অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতাকে অসাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত রায়ে বলেন, ‘৫৪ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগে চরমভাবে স্বেচ্ছাচারিতা লক্ষ্য করা যায়। এ ধারার ভাষাতেও অস্পষ্টতা আছে। তবে কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যে কোনো নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে আটক বা প্রহরায় নেয়া অন্যায়, বেআইনি ও অসাংবিধানিক। কারন ৫৪ ধারায় ওয়ারেন্ট ছাড়া আটক এর যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তা সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিধানগুলোর পরিপন্থী। ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার যদি করতে হয় তা হতে হবে সুনির্দিষ্ট, বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিসঙ্গত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে। কোনো ক্রমেই নাগরিকের ব্যক্তি স্বাধীনতা অন্যায়ভাবে হরণ করা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার ক্ষমতাবলে যখন তখন রিমান্ড চাওয়া ও মঞ্জুর করা সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী।’ এ অবিচার বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। আইনের শাসন ও মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় এ জাতি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। কিন্তু আমরা আজও আইনের মাধ্যমে নির্যাতন বন্ধ করতে পারিনি। এটি খুবই হতাশ ও দুঃখজনক বটে। উল্লিখিত রায়ে আরো বলা হয় ‘পুলিশ সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আমলযোগ্য কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করেই কেবল কোনো অভিযুক্ত বা সাক্ষীকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে। তাও গ্রেপ্তারের কারণ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করতে হবে। গ্রেপ্তারের পরপরই গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনকে সংবাদ দিতে হবে। গ্রেপ্তারের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেও কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে।’ আমাদের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদেও গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যাপারে পদ্ধতিগত সুরক্ষা দিয়েছে যেমনÑ‘গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাশীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া পুনরায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাবে না। কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে। বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। ওই ব্যক্তিকে আবার জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাঁচনির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন।’ জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারী পরীক্ষা করাতে হবে। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। ২৪ এপ্রিল’ ২০১৬ মঙ্গলবার সকালে ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে এর নির্দেশনায় এসব কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
বন্ধুবর পাঠক! আইনে এসব থাকার পরও ফজলু মিয়ার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া ২২টি বছর রাষ্ট্র কিংবা আইন কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা।Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
ফ