শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ০৭:০১ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
ভূমি হতে বেদখল হলে কি করবেন?

ভূমি হতে বেদখল হলে কি করবেন?

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ নিরীহ গরীব কৃষক জামাল খাঁ পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত এক টুকরো জমি ভোগদখল করে আসছিল। প্রভাবশালী প্রতিবেশী রজব খাঁর কু-নজর পড়ে ওই জমির উপর। অবশেষে ওই জমির উপর মালিকানা দাবি করে রজব খাঁ জমিটুকু দখল করে নেয়। অবশেষে নিরুপায় হয়ে কৃষক জামাল খাঁ জমির দখল পূণরুদ্ধারে আদালতে মামলা দায়ের করেন।

উপরোক্ত ঘটনা আমাদের সমাজে অতি পরিচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কোনো ব্যক্তি মালিকানা দাবী করে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি বেশ কিছুদিন ধরে ভোগদখল করে এলে তাতে তার স্বত্ব আছে বলে আইন মোতাবেক ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কোনো কারণে সমাজের কিছু অসৎ ও প্রভাবশালী লোকের ভূমিখেকো মানসিকতার কারনে উক্ত জামাল খাঁর মতো ভোগদখলকৃত জমি হতে বেদখল হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। তখন দখলচ্যূত ব্যক্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এ সম্পত্তি তখন ভূমিখেকোর ভোগদখলের বিষয়ে পরিণত হয়। এ রকম ঘটনা আইনের দৃিষ্টতে অপরাধ এবং নির্দিষ্ট আইনে প্রতিকার পাওয়ার জন্য মোকদ্দমা করার অধিকার ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির রয়েছে। ভূমি হতে অবৈধভাবে দখলূচ্যত হলে দখল পুনুরুদ্ধারের জন্য ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার পেতে পারে।

এ আইনের ৮ ধারানুযায়ী ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসারে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বেদখলকৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পারেন। তবে এ ধারানুযায়ী, দখলচ্যূত ব্যক্তিকে ওই ভূমিতে তাঁর স্বত্ব ছিল বা আছে বলে প্রমাণ দিতে হবে, নইলে এ ধারানুযায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়।

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় উল্লেখ আছে, যথাযথ আইনগত পন্থা ব্যতীত যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর অসম্মতিতে বেদখল হন, তবে তিনি বা তাঁর মাধ্যমে দাবিদার কোনো ব্যক্তি মোকদ্দমার মাধ্যমে এর দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন, যদিও এমন মোকদ্দমায় অপর কোনো স্বত্ব দাবি করা হতে পরে ।
এ ধারানুযায়ী মামলা করার ক্ষেত্রে বাদী শুধু দখলূচ্যত হয়েছে এ মর্মে প্রতিকার চাইতে পারেন, স্বত্ব বা দখল প্রমাণের দরকার নেই। ৮ ধারার সংগে ৯ ধারার এখানেই পার্থক্য। ৯ ধারার ক্ষেত্রে যেসব দিক বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো: বাদী জমিটি ভোগদখল করে আসছিলেন কি-না । বিবাদী তাঁকে জোর পূর্বক বেদখল করেছেন কি-না, বিবাদী বেআইনিভাবে জমিতে প্রবেশ করেছেন কি-না। তবে ৯ ধারার প্রতিকারের ক্ষেত্রে তামাদি আইন অনুযায়ী, বাদীকে অবশ্যই বেদখল হওয়ার তারিখ হতে ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে এ ধারায় মামলা করার অধিকার হারাতে হবে।

৮ ধারার স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রতিকারের ক্ষেত্রে মূল্য বাবদ নির্দিষ্ট এখতিয়ারাধীন আদালতে মামলা করতে হবে।

দখল পুনরুদ্ধার মামলার ক্ষেত্রে, মূলত সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারানুযায়ী যেসব মামলা দায়ের করা হয়, সেগুলোকে স্বত্ব সাব্যস্ত খাস দখলের মামলা বলা হয়। এতে অবশ্যই স্বত্ব প্রমাণসহ খাস দখলের ঘোষণা চাইতে হবে। মামলা জবাবে বিবাদী যদি এক বা একাধিক দলিল দাখিল করেন, তাহলে এ ক্ষেত্রে ৩৯ ধারানুযায়ী পৃথক দলিল বাতিলের মোকদ্দমার দরকার পড়ে না। কারণ

৮ ধারাতেই সব বিষয়ে স্বত্ব প্রমাণসহ দখলের ব্যাপারে প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু ৪২ ধারা মতে স্বত্ব ঘোষণার মামলাও বাদী করতে পারেন না, কারণ এ ধারা অনুযায়ী দখল উদ্ধার ছাড়া স্বত্ব ঘোষণা চাওয়া যায় না। তবে ৮ ধারায় মোকদ্দমার আরজিতে এবং মামলার রায়ে ৪২ ধারার বিষয়টি অন্তর্নিহিত থাকে। এ ক্ষেত্রে জমির মূল্য বাবদ অ্যাডভ্যালোরেম  কোর্ট ফি দিতে হবে।

৯ ধারানুযায়ী, বেদখল হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মামলা করতে হবে। এতে স্বত্ব প্রামাণের প্রয়োজন পড়ে না। সম্পত্তির মূল্য অনুসারে যে কোর্ট ফি, অর্থাৎ অ্যাড-ভ্যালোরেম কোর্ট ফি-র অর্ধেক পরিমাণ কোর্ট ফি দিতে হবে। তবে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধারায় মোকদ্দমা চলে না।
৮ ও ৯ ধারার ক্ষেত্রে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য বাদী যদি মনে করেন যে, তাঁর নালিশি জমিটি দখলকৃত বিবাদীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা হলে তিনি আদালতের কাছে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন পৃথক আবেদনের মাধ্যমে।

কেউ জোর করে বেদখল করলে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ১৪৪ ফৌজদারি কার্যবিধির ধারায় মামলা করে জমির দখল ফেরত পাওয়া যায়। এ জন্য বেদখল হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে মামলা করতে হয়। ৬০ দিন পর মামলা করলে পুনর্দখল দিতে পারে না। ১৪৪ ধারার মামলা করলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত একই আইনের ১৪৫ ধারায় জমি ক্রোক করতে পারে। ফৌজদারি আদালতে মামলা করলেও দেওয়ানি আদালতের দরজা খোলা থাকে। দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে কোন বাধা নেই।
মারপিট বা শাস্তি ভংগের আশংকা থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এই মামলা করে রাখা ভাল। এই মামলা করা হলেও দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে কোন বাধা নেই।

যিনি দখলে আছেন তিনি দখলে থাকবেন এটাই সাধারণ নীতি। যার দখল আছে তাকে যদি শক্তির জোরে বেদখল করার ব্যাপারে আইন সায় দিত তবে সকলে বল প্রয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ত। তাই আইনে বলপ্রয়োগকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এই আইন করা হয়েছে। যার দখল নেই কিন্তু স্বত্ব আছে, সে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবে না। শক্তির জোরে দখলদার ব্যক্তিকে জমির দখলচ্যুত করা যাবে না। তবে স্বত্ববান ব্যক্তি বেআইনি বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে তার দখল বজায় রাখায় জন্য আইনি সহায়তা পাবেন। স্বত্ববান ব্যক্তি প্রয়োজনে দখল পুনরুদ্ধারের মামলা করে জবর দখলকারকে বিতাড়িত বা দখলচ্যুত করতে পারে।
রহিম সাহেব ঢাকায় চাকরি করে। তার যশোরে একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে কামালকে থাকার জন্য সুযোগ দিলেন। এখন রহিম সাহেব চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। গ্রামে এসে থাকতে চান। তিনি আইনত কালামকে গায়ের জোরে বাড়ি হতে বের করে দিতে পারবেন না। স্বেচ্ছায় না যেতে চাইলে করিম সাহেবকে দেওয়ানি আদলাতে মামলা করে কালামকে বেদখল করতে হবে। যদি জোর করে বের করে দেন তবে কালাম দেওয়ানি আদালতে মামলা করে তার দখল বজায় রাখতে পারবে। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় এই বিধান করা হয়েছে। এখানে দখলকারীর স্বত্ব বিবাদীর স্বত্বের চেয়ে ভাল বা বিবাদীর কোন স্বত্ব আছে কি না তা দেখার কোন দরকার হয় না। এখানে আদালত স্বত্বের বিষয় বিবেচনা করেন না। শুধুমাত্রা দখলের বিষয় বিবেচনা করেন। বেদখল করা হয়েছে কি না তাও বিবেচনা করেন। জমির মালিক না হয়েও মালিকের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে দখলচ্যুত করার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। সাধারণজ্ঞানে মনে হতে পারে এ কোন ধরনের উদ্ভট আইন। কিন্তু মানুষ যাতে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা না বাধায় সেই জন্য দেশে দেশে এই আইন করা হয়েছে। যিনি দখলে আছেন তিনি যেন শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে পারেন। যিনি দখলে আছেন তাকেই প্রথমে আইনত দখলের অধিকারী বলে মনে করা হয়। স্বত্বের অধিকারী হলে দেওয়ানি আদালতে উচ্ছেদের মামলা করতে কোন অসুবিধা হয় না। বেদখল হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে এই মামলা দায়ের করতে হয়। এই সময় পার হয়ে গেলে তামাদির কারণে মামলা করা যায় না।
আপনার অনুমতি ছাড়া যদি কেউ আপনার জমি দখল করে নেয় তবে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করতে পারেন। ঘর-বাড়ির জমি হলে দ-বিধির ৪৪৮ এবং অন্য জমি হলে ৪৪৭ ধারায় মামলা করতে হয়। এই মামলায় বেআইনি অনুপ্রবেশকারীর জেল জরিমানা হতে পারে। এছাড়া প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় মামলা করা যায়। এমনকি বেআইনিভাবে বেদখল করার জন্য দখল ফিরে পাওয়ার সাথে ক্ষতিপূরণের জন্যও মামলা করা যায়।

অবশেষে গরীব কৃষক জামাল খাঁ ভূমি হতে অবৈধভাবে দখলচ্যূত হলেও ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ও ৯ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা মোকদ্দমা করে প্রতিকার পান।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

 

 

 

 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel