এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: অপরাধ সংঘটনের পর বিচারপ্রার্থীর প্রথম কাজ হলো থানায় মামলা দায়ের করা। এরপর মামলা তদন্তের মাধ্যমে শুরু হয় বিচারকাজ। পুলিশ বিনামূল্যে সে মামলা নিতে বাধ্য। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, প্রভাবশালীদের চাপে থানার পুলিশ মামলা নিতে চায় না। মামলার বাদী তুলনামূলক দুর্বল হলে থানার পুলিশ এ ধরনের আচরণ করে থাকে বলে অভিযোগ শোনা যায়।
এ রকম অবস্থায় আইনের বিধান কী? পুলিশ যদি মামলা নিতে নাই চায়, সে ক্ষেত্রে তাদের বাধ্য করার মতো কোনো সুযোগ আছে কি? হ্যাঁ, চারটি উপায়ে পুলিশের নির্লিপ্ততার বিরুদ্ধে ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার প্রতিকার পেতে পারেন। পর্যায়ক্রমে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা
কোনো কারণে পুলিশ যদি কখনো মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের (বিচারিক হাকিম) আদালতে নালিশি অভিযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করা যায়। তবে সংঘটিত অপরাধ আমল-অযোগ্য হলেও থানায় না গিয়ে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশি মামলা করা যায়। আমল-অযোগ্য অপরাধ হলো, যেসব অপরাধ সংঘটনের কারণে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে না এবং ওইসব অপরাধের বিষয়ে তদন্ত করতেও সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়।
যেভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করবেন:
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মৌখিকভাবে অভিযোগ করতে চাইলে ঘটনার আদ্যোপান্ত আদালতে খুলে বলে ঘটনার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে আবেদন করতে হবে। এরপর ওই অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে কি-না, তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীকে এবং প্রয়োজন মনে করলে ঘটনার কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁদের শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষার সারসংক্ষেপ লিখে তিনি নিজে, অভিযোগকারী ব্যক্তির ও কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁর স্বাক্ষর নেবেন। কেউ দরখাস্ত আকারে ঘটনার পূর্ণ বিবরণসহ লিখিত অভিযোগ করে প্রতিকার দাবি করলে এরূপ শপথ পরীক্ষাসহ এ ক্ষেত্রে জবানবন্দি নেবেন। এ রকম অভিযোগে একটি কমপ্লেইন রেজিস্টার কেস নম্বর বা কমপ্লেইন রেজিস্টার পিটিশন কেস নম্বর দিয়ে নথিভুক্ত হয়। এ জন্য একে সিআর মামলাও বলে।
শপথ পরীক্ষার সময় এবং জবানবন্দি নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট যদি অপরাধ সংঘটন বিষয়ে অভিযোগকারীর বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হন অথবা অভিযোগকারী মামলার ভিত্তি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে না নিয়ে আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন। নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশনের আবেদন করতে পারেন।
অভিযোগ আমলে নেওয়ার ফলাফল ও তদন্তে পাঠানো:
অভিযোগটি আমলে নিলে ম্যাজিস্ট্রেট বিবাদীপক্ষের বিরুদ্ধে সমন জারি করে (ক্ষেত্র বিশেষে ওয়ারেন্ট জারি করে) আদালতে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের নির্দেশ দিতে পারেন অথবা আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নিতে থানাকে নির্দেশ দিতে পারেন। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে আদেশপ্রাপ্ত হলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগটি থানায় এজাহার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নেবে। আবার আমল-অযোগ্য অপরাধের বেলায় বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত করতে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আদিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অভিযোগটির বিষয়ে তদন্ত শুরু করবে এবং তদন্তকালীন আমলযোগ্য অপরাধ তদন্ত করার মতোই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে।
তবে প্রয়োজন মনে করলে ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অথবা অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও তদন্তকাজে সম্পৃক্ত করতে পারেন।
হাইকোর্টে মামলা
দ্বিতীয় প্রক্রিয়া হলো থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে প্রতিকার চাওয়া যায়। রিট আবেদনে ভিকটিম বা তার পরিবার থানায় মামলা দায়েরের অনুমতি প্রদান ও আসামিদের গ্রেফতারের আদেশ প্রার্থনা করতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগ রায় প্রদান করলে পুলিশ রায় মানতে বাধ্য।
মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ
পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে প্রতিকার চাওয়ার তৃতীয় মাধ্যম হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এ ছাড়া বেসরকারি মানবাধিকার কমিশনের কাছেও এ ধরনের অভিযোগ দেওয়া যায়। বিশেষ করে নারী নির্যাতন ও মানবিক বিষয়গুলো মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন করলে তাঁরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
মনে রাখা জরুরি:
নালিশি মামলার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রথম থেকেই পক্ষ হয়ে মামলা শুরু করে না। যেমনটা থানায় এজাহার রুজুর মাধ্যমে মামলা করলে রাষ্ট্র নিজে পক্ষভুক্ত হয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনা করে। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে নেওয়ার আদেশ দিলে রাষ্ট্র তখন মামলার পক্ষ হয়ে পরবর্তী সময়ে মামলা পরিচালনা করে। তাই নালিশি মামলার ক্ষেত্রে কেউ অভিযোগ করে পরবর্তী শুনানির দিন যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির না হয় বা ঘটনা তদন্ত শেষে যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ না হয়, তবে ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি খারিজ করে দিতে পারেন। অভিযোগকারী চাইলে এ ধরনের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে বা হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন আবেদন করতে পারেন।
শেষ কথা:
থানায় কখনো মামলা নিতে না চাইলে বিচলিত হয়ে নিজেকে অসহায় ভাবার কোনো কারণ নেই। আইন অনুযায়ী যে কেউই এ রকম পরিস্থিতিতে সরাসরি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে নালিশি মামলা করে আইনের আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। আমাদের দেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থীরা থানায় আইনের আশ্রয় না পেলে পুলিশকে টপকে অজ্ঞতা, দৈন্য ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন না। জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের আইনি সহায়তা প্রদান কর্মসূচিও ব্যাপক পরিসরে বাড়ানো উচিত।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক দৈনিক ‘ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com