বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১২ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ ড. আজাদুর রহমান, আমার দৃষ্টিতে এক অনন্য কিংবদন্তি। নানা চরিত্রের বাঁক ঘুরে তিনি এখন রীতিরকম চারণ কবি। পৃথিবীতে কিছু আলোকিত মানুষের জন্ম হয় যাদের জ্ঞান, মেধা, মনন, আদর্শ দেশ ও জাতির সেবায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকে। এমনই আলোকিত মানুষ তিনি। মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক এবং সম্পূর্ণ নির্লোভ এক চরিত্রের মানুষ তিনি। সরকারের প্রশাসন ক্যাডারের উপ-সচিব পদমর্যাদার এ মানুষটি দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা যেন তাঁর প্রাণশক্তি। চলনে-বলনে-আচরণে-বক্তৃতায়-রচনায় দীর্ঘদিন ধরে কাব্য প্রেমিকদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন। তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ব্যাগভর্তি রাতের করতালি’। কাব্যগ্রন্থের সবগুলো কবিতা আমাদের জাতির শেকড় সন্ধানী অনুষঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিহাস ঐতিহ্য খুঁড়ে খুঁড়ে তিনি জাতির শেকড়ের সন্ধান করছেন। তার সেই অনুসন্ধানী মন আজো নিরন্তর চলমান। বেগবান ¯্রােতের মতো ধেয়ে চলেছে তাঁর কাব্যতরী। জীবনের চলমান অস্থিরতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অন্যায় এবং অসুন্দরের বিরুদ্ধে তার কলম সমবেগে ধাবমান। তিনি নানা মাত্রায় কাব্য রচনা করে থাকেন। তাঁর কাব্য নিয়ে ঢাউস গ্রন্থ রচনা করা যায়। কিন্তু সেটা আমাদের জন্য শোভন হবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ আমি কবি নই। আমি কবিতা লিখতে পারি না। আমি আইনের মানুষ। আইন নিয়ে লিখি, আইন গবেষণা করি। কবিতা নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলা আমাকে মানায় না। একজন কবি এই বলে আমাকে প্রশ্ন করলে আমার জবাব দেয়ার কিছু থাকবে না।
তার চেয়ে বরং কবি ড. আজাদুর রহমানের ব্যক্তি জীবন নিয়ে লেখা আমার জন্য অনেকখানি নিরাপদ। আমি বরং সেইদিকে কামান ঘুরিয়ে দেই।
কবির সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি দেখা হয় ২০০৭ সালে। তখন তিনি কুষ্টিয়া লালন একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক ও প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট। আইন পেশা ও লেখালেখির সুবাদেই সখ্যতা। তারপর হৃদ্যতা, গভীরতা, ভালবাসা, ভাললাগা, প্রেম। সেসময় কবিকে দেখেছি গভীরভাবে পরিচিত হতে লালনের কীর্তিকর্মের সাথে। হয়ত কাজের খাতিরেই বাউলদের সাথে মেশামিশি। ময়দানের মজমাতে বসে সাধু ফকিরদের সাথে আলাপ পরিচয়, কথোপকথন। দোল পুর্ণিমার মচ্ছবে অবলোকন করেছেন-সাধুসেবা, দীক্ষা গ্রহণের নিয়ম কানুন আর ফকিরি বৃত্তান্ত। তরতাজা জিজ্ঞাসা, সরাসরি আলাপকথন এবং বৈজ্ঞানিক মনমানষিকতার সরেজমিন বিচার বিশ্লেষণ তাঁর নির্মাণকে আরও মজবুত করেছে, এনে দিয়েছে অনন্য মাত্রা। সেকারণেই আখড়াবাড়ির বাউলরা স্বশরীরে উঠে আসেন তাঁর লেখায়।
এভাবেই আমাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সুতোর বন্ধন তৈরি হলো। ধীরে ধীরে বন্ধনের সেই শেকড় হৃদয়ের আরো গভীরে প্রথিত হয়। কিভাবে হয় তার কোনো ব্যাখ্যা আমি আজো খুঁজে পাইনি। কবি আজাদ চাকুরীর সুবাদে কুষ্টিয়া ছেড়ে চলে গেল। দ্রাবিড়ের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে গেলো। কিন্তু আমার হৃদয়ের টান থামলো না। প্রবল প্রতাপে তা আরো বাড়তে লাগলো। কত কথা, কত স্মৃতি আমার। হাস্যরস, আড্ডা, পানাহার, হৈহুল্লোড় কিছুই বাদ যায়নি। আজো সমানতালে বহমান। তিনি যেমন আমার প্রশ্রয় দিয়েছেন, সহ্য করেছেন আমার লাগামহীন আব্দার এবং অত্যাচার।
এবার একটি ভালোলাগার কথা বলি। এইতো কয়েকদিন আগে এসেছিল কুষ্টিয়ায়। ১লা কার্তিকে লালন স্মরণোৎসবে। উঠেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেষ্ট হাউজে। আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, কুষ্টিয়া এসেছি; আর তোমার সাথে দেখা হবে না; এ যেন অসম্ভব ব্যাপার। আমি মোটর বাইক নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। পরের গল্প আজ আর নাই বা বললাম।
প্লাস্টিকসভ্যতায় দাঁড়িয়ে সনাতন সুন্দর পৃথিবীর জন্য তাঁর কবিতাগুলি কাঁদে। তিনিও কি কাঁদেন? তাঁর কবিতাগুলি পড়তে পড়তে আমরা আমাদের হৃদয়ে এমন একটি পৃথিবী-ছায়ার শান্তি ও শীতলতা অনুভব করি, যে-পৃথিবীতে আমরা আজ আর বাস করি না। সুদূরের সেই পৃথিবীতে বাস করে গেছেন আমাদের ফসল-ফলানো পূর্বপুরুষগণ। তাই নগরনরকে বসেও প্রেম পাখি নদী নারী ফুল শস্য গ্রাম শৈশব স্মৃতি ও সবুজের জন্য আকুল হয়ে ওঠে আমাদের অন্তর-মন। পানিতে পা ডুবিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করে। কবিতাগুলি আচ্ছন্ন করে আমাদের প্রস্তরশোভিত জীবনের দিনরাত্রি। এই জীবন-যাপন থেকে লাফ দিয়ে জলে নেমে জল হতে ইচ্ছে করে আমাদের। তিনি অন্তরে-অন্তরে প্রতিপালন করে চলেছেন একজন প্রকৃত কবির আত্মা। সম্প্রতি চৈতন্য প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে কবিতার বই-ব্যাগভর্তি রাতের করতালি। কাজের সাথে পুরোদমে লেখালেখি করেন তিনি। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সাহিত্যপাতায় নিয়মিত গল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার লেখেন। সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন ফকির লালনের উপর।
প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়-লালন মত লালন পথ (২০১০, অন্বেষাপ্রকাশনী), সাধুরবাজার, লালনেরগান (অন্বেষা), বাংলার মেঠো পথে(২০১১ জয়তী),কোলকাতা বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে গল্পসমগ্র-অন্য কোনওখানে (২০১৪, সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী, কোলকাতা), ব্যাগভর্তি রাতের করতালি (২০১৭-১৮)।
আজাদুর রহমানের জন্ম ৪ ডিসেম্বর। বগুড়া জেলার সোনাতলা থানার অধীন গড়ফতেপুর গ্রামের কলেজপাড়া। জন্মদিনে কবিকে অন্তরের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে প্রেম, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলাম। ভাল থাকুন কবি।