ডা সুরেশ তুলসান: আমাদের দেশে আমরা অর্থাৎ ডাক্তারদের একটা বড় একটা অংশ একটা সাধারণ সমালোচনার শিকার হই এবং সেটা হলো আমরা রোগীদের সাথে ঠিকমতো কথা বলি না। আমরা ভাবি রোগীদের সেবা দিতে তো আমরা কোন কার্পণ্য করছি না।
সেবা তো ঠিকঠাকই দিচ্ছি। অতো বোঝানোর কি আছে। গলদটা এখানেই। বিষয়টা অনেকটা এরকম। একই পরিবারে একে অন্যকে ভালোবাসার মত। শুধু মুখ বুঁজে শুধু ভালোবাসবেন, প্রিয়জনেদের প্রতি কর্তব্য পালন করবেন তা হবে না।
মাঝে মধ্যে বলতে হবে আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাকে বোঝাতে হবে আমি তার প্রতি কতটা দায়িত্বশীল, তার জন্য আমি কি করছি, কেন করছি এবং এসবের ভালোমন্দ সম্পর্কিত ধারনা তাকে দিতে হবে। তা নাহলে অনাস্থা আর অবিশ্বাস। পরিবারের মানুষই যখন মুখ ফুটে কিছু না বললে বুঝতে চায় না, বাইরের মানুষ আমাকে বুঝবে এমনটা আশা করা মোটেও উচিৎ না। রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি সেই রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কিছুর পুংখানুপুংখ বুঝে নেয়ার ইচ্ছে এবং অধিকার রোগীর এবং রোগীর স্বজনদের থাকে। চিকিৎসা পরিভাষায় আমরা বলি কাউন্সিলিং। একবার এই কাউন্সিলিং ঠিকঠাক না করার কারনে আমার এক বৃদ্ধ রোগীর হাতে আচ্ছামতো অপদস্থ হতে হয়ে হয়েছিলো আমাকে।
গল্পটা এরকম। একবার একজন বয়স্ক রোগী হঠাৎ প্রস্বাব আটকে যাওয়ায় প্রস্টেট অপারেশন এর জন্য আমার অধীনে কুষ্টিয়াতে একটি ক্লিনিকে ভর্তি হন। প্রস্টেট গ্রন্থির অপারেশন এর পূর্বে রোগীর প্রস্টেট এর আকার এবং প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারনা নেয়ার জন্য রোগীর মলদ্বারের ভিতরে আংগুল দিয়ে একটি পরীক্ষা করতে হয়। যার নাম চিকিৎসা পরিভাষায় "ডিজিটাল রেকটাল এক্সামিনেশন।" তবে এই পরীক্ষাটি করার পুর্বে রোগীকে এই পরীক্ষার বিষয়ে ভালোমতো বুঝিয়ে শুনিয়ে রোগীর অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি না নিয়ে মলদ্বারে আংগুল দিলেই কিন্তু সমুহ বিপদ। সেই বিপদেই আমি পড়েছিলাম। অতি বৃদ্ধ রোগী। চোখে ঠিকমতো দেখেন না, কানে ঠিকমতো শোনেন না, যেটুকু শোনেন তার কতটুকু বুঝবেন সেটাও সন্দেহ। আর প্রস্টেট অপারেশন এর পূর্বে মলদ্বারে আংগুল দিয়ে পরীক্ষা করা লাগবেই যেহেতু, তাই আমি এ বিষয়ে কোন কিছু ভালোমতো না বুঝিয়েই মলদ্বারে আংগুল দিয়ে পরীক্ষাটা করে ফেললাম। ফলাফল কিন্তু হাতেনেতেই পেতে হলো। বৃদ্ধ মানুষটা তো রেগেবেগে আগুন। বাড়ী থেকে ছেলেকে ডেকে পাঠালেন। ছেলে আসার সাথেসাথেই ছেলেকে বললেন। " তুই আমারে কোন নিয়াইছিস। ডাক্তারের কাম রোগী দেখা, রোগী দেখবি। বকা কাম করবি কি করতে ?" (বকা কাম বলতে আমাদের এ অঞ্চলে অশ্লীল কিছু বোঝানো হয়ে থাকে সাধারণত।)
ছেলে জিজ্ঞেস করলো-
" ক্যা বাপ তোর কি হইছে ?
এতো রাগ করছিস ক্যান ?
ডাক্তার তোরে কি করছে ? "
বাপ আরও রেগে উত্তর দিলেন-
" আমারে যা করার তা তো
করেই থুইছে।
সেতা আমি আর সবাইরে
কবো ক্যান ?
আমার পেশাবের রাস্তার এই
নলটা খুলে দিবার কও,
আমি বাড়ী যাবো।"
ছেলেকে বোঝালাম নল খুলে দিলে আবার প্রশ্বাব আটকাবে,
কষ্ট পাবে বুড়ো মানুষটা ।
ছেলে বললো,
"আমার বারো-- চু-- ( লেখার
অযোগ্য) বাপ খুব জেদি, জেদ যখন চাপছে, কারো কথা শুনবি নানে,স্যার আপনি নলটা খুলে দ্যান,
পেশাব আটকাউক, চো-- ( লেখার অযোগ্য) পরলে নিজেই কবিনানে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলো। তখন না হয় আবার নিয়ে আসবো। আমার একটু কষ্ট হবিনে, এই আর কি। " বলা বাহুল্য রোগীটা আমাকে তখনকার মতো ছেড়ে দিতেই
হলো। সন্ধ্যায় সেই ক্লিনিকেই অপারেশন করছি, হঠাৎ ওটি স্টাফদের মাঝে গুঞ্জন, কারন জানতে চাইলে একজন বললো --" স্যার সকালের সেই রাগ করে ফেরৎ যাওয়া বয়স্ক দাদুটা আবার এসেছে। আবার প্রস্বাব আটকে গেছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে," ওটি শেষের দিকেই ছিলো, বাইরে এসে দেখলাম, বৃদ্ধ মানুষটা যারপরনাই কষ্ট পাচ্ছেন, তলপেট ফুলে টানটান।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। ক্যাথেটার দেয়ার সাথে সাথেই ইউরিন ব্যাগটার প্রায় পুরাটাই
ভরে গেলো, তিনি তাৎক্ষণিক আরাম আর প্রশান্তি লাভ করলেন, একমুখ কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে আমার হাতটা জড়িয়ে
ধরলেন। আমাকে সরি বলার সুযোগটাই দিলেন না।
লেখকঃ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ এর সহকারী অধ্যাপক
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com