বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৮ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ সন্তান জন্ম দান ও লালন-পালন কারী পিতা-মাতা যেন সন্তান কর্তৃক অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার না হন সেজন্য রয়েছে আইন। এমনকি বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও থাকলেও পিতা-মাতাকে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। সব পিতা-মাতাই সন্তানের মঙ্গল চান। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে কোনো সন্তান যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণে পিতা-মাতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, তাহলে তাঁরা আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের অধিকার আদায় করতে পারেন।
সন্তানের সম্পত্তিতে পিতা-মাতার অধিকারঃ
বাবা তার মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে তিনভাবে উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন। (ক) যদি মৃত সন্তানের পুত্র, পুত্রের পুত্র বা পুত্রের পুত্রের পুত্র এভাবে যতই নিচে হোক না কেন কোনো পুত্রের অস্তিত্ব থাকে, তবে মৃত সন্তানের পিতা পাবেন তার সম্পত্তির ১/৬ অংশ। (খ) যদি মৃত সন্তানের কেবল কন্যাসন্তান বা তার পুত্রের কন্যাসন্তান থাকলে তবে পিতা তার সম্পত্তির ১/৬ অংশ পাবেন। এই ক্ষেত্রে কন্যাদের ও অন্যদের দেয়ার পর অবশিষ্ট যে সম্পত্তি থাকবে তাও পিতা পাবেন। (গ) আর যদি মৃত সন্তানের কোনো পুত্র-কন্যা বা পুত্রের সন্তান কিছুই না থাকে তবে বাঁকি অংশীদারদের তাদের অংশ অনুযায়ী অংশ দেয়ার পর অবশিষ্ট যা থাকবে তার সবটুকুই বাবা পাবেন।
মাতাও তার মৃত সন্তানের সম্পত্তিতে তিনভাবে অংশ পেয়ে থাকেন। (ক) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি (যত নিচেই হোক) থাকলে অথবা যদি মৃত ব্যক্তির আপন বৈমাত্রেয় বা বৈপিত্রেয় ভাই-বোন থাকলে তবে মা ছয় ভাগের এক ভাগ (১/৬) পাবেন। (খ) মৃত ব্যক্তির কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে এবং যদি একজনের বেশি ভাই বা বোন না থাকে তবে মাতা তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) পাবেন। (গ) কোনো সন্তান বা পুত্রের সন্তানাদি যত নিম্নের হোক না থাকলে অথবা কমপক্ষে দুজন ভাই-বোন না থাকলে এবং যদি মৃত ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রীর অংশ বাদ দেয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) মাতা পাবেন। মৃত ব্যক্তির এক ভাই থাকলেও মাতা ১/৩ অংশ পাবেন।
সন্তানের কাছে বিধবা মায়ের অধিকারঃ
একজন বিধবা নারীকে তার স্বামীর মৃত্যুর পর কোনভাবেই তার বাসস্থান থেকে জোর করে বের করে দেয়া যাবে না। স্বামীগৃহ, যেখানে তিনি বসবাস করছেন, এ গৃহে তার বাস করার অধিকার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তার প্রাপ্য সম্পত্তি তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তবে তিনি স্বেচ্ছায় অন্য কোথাও থাকতে চাইলে তাকে বাঁধা দেয়া যাবে না। তিনি অন্যত্র বিয়ে না করলে তার সন্তানদের তত্ত্বাবধান করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না। একজন বিধবা স্ত্রী স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির সন্তান থাকা অবস্থায় ১/৮ এবং সন্তান না থাকলে ১/৪ অংশ পাবেন।
একজন নারী তার স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দতকালীন (চার মাস ১০ দিন) সময় পার করার পর নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী অন্য সাধারণ নারীর মতো স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে কোনভাবে তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তিনি অন্যত্র বিয়ে করবেন কি করবেন না, এটা তার সম্পূর্ণ স্বাধীন সিদ্ধান্তের ব্যাপার।
সন্তানের কাছে মায়ের দেনমোহর ও ভরণপোষণের অধিকারঃ
একজন বিধবা তার স্বামীর পরিশোধ করে না যাওয়া দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। স্বামীর মৃত্যু হলেই যে দেনমোহর পাবেন না, তা নয়। দেনমোহর ঋণের মতো, স্বামীর অবর্তমানে স্বামীর উত্তরাধিকারীরা তা পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর পরিশোধ না করা হলে স্বামীর মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা করে তিনি তা আদায় করতে পারবেন। এছাড়া স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অংশ একজন বিধবা স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবেন কিংবা দখলে রাখার অধিকার রয়েছে বলে বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ (১৮৭১) ১৪ এম.আই.এ. পৃষ্ঠা ৩৭৭ এ উল্লেখ রয়েছে। একজন বিধবা মা তার সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ পেতে হকদার। সন্তানেরা ভরণপোষণ না দিলে আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। (জমিলা খাতুন বনাম রুস্তম আলী, ৪৮ ডিএলআর (আপিল বিভাগ), পৃষ্ঠা ১১০।
দেনমোহরের দাবীতে কোন বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি দখল করে থাকলে যদি তাকে অন্যায়ভাবে সেই সম্পত্তি হতে বেদখল করা হয়, তবে সে দখল পূণরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। (মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব (১৯১৬) ৪০ বম. পৃষ্ঠা-৩৪)
বিধবা মা অন্যত্র বিয়ে করলেও আগের স্বামীর সম্পত্তি পাবেনঃ
স্বামী কিংবা স্ত্রী একে অপরের মৃত্যুতে সবসময়ই উত্তরাধিকারী হবেন। এ ক্ষেত্রে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী অন্য কাউকে বিয়ে করলেন কি-না, উত্তরাধিকারী হওয়ার ক্ষেত্রে এটি মোটেও কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যত্র বিয়ে করলেও তাকে কোনোভাবেই স্বামীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
অন্যত্র বিয়ে করার দোহাই দিয়ে কোনো স্বামী বা স্ত্রীকে যদি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়, সে ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ পক্ষ দেওয়ানি আদালতে মামলা করে তার অংশ আদায় করে নিতে পারবেন। এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আদালত মৃত ব্যক্তির পুরো সম্পত্তির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওই সম্পত্তি কোনোভাবে হস্তান্তর কিংবা জমিতে কোনো স্থাপনা তৈরি করা যাবে না।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনঃ
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩, কতগুলো বাধ্য-বাধকতার নির্দেশ দিয়েছে। একাধিক সন্তান থাকলে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করবে এবং তাদের একইসঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করবে। পিতা বা মাতা অথবা তাদের উভয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করা যাবে না। প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করবে। যেক্ষেত্রে পিতা বা মাতা জীবিত নেই সেক্ষেত্রে দাদা-দাদী অথবা নানা-নানি জীবিত থাকলে এই আইন অনুযায়ী তাদেরকেও ভরণপোষণ দিতে হবে।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না করার দণ্ডঃ
কোনো সন্তান এ আইনের বিধান লংঘন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদ-ে দ-িত হবে; বা উক্ত অর্থদ- অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব ৩ (তিন) মাস কারাদ-ে দ-িত হবে। এমনকি কোন পুত্রবধু বা মেয়ের জামাই অথবা অন্য কোন নিকট আতœীয় যদি পিতা-মাতার বা দাদা-দাদীর বা নানা-নানীর ভরণ-পোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করেন বা ভরণ-পোষণ প্রদানে অসহযোগিতা করেন তাহলে তিনি উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং তিনিও দ-ে দ-িত হবেন।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮