বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৯ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: কেস ষ্টাডি-১। রহিম ও করিম মিয়া একে অপরের প্রতিবেশী। রহিম মিয়ার দুই ছেলে ভাল চাকুরে। একটি বাড়ি নির্মাণ করছেন। বাড়ি এমনভাবে নির্মাণ করছেন যে করিম মিয়ার বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে, আলো-বাতাস কিছুই ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারছে না। এমনকি করিম মিয়ার যাতায়াতের যে পথ, তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিংবা বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে কোনো অনুমতি ছাড়া বাড়ি তৈরি করছেন রহিম মিয়া। এখন কী করবেন প্রতিবেশী করিম মিয়া? সহজ উত্তর বাড়ি নির্মাণের সময় অবশ্যই প্রতিবেশী করিম মিয়ার সুখের কথা তাঁর আগে চিন্তা করতে হবে।
ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২ ও ২০০৬ অনুযায়ী ভবন নির্মাণ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ভবন ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ, আবাসিক বাড়ির জন্য অনুমতি নিলে ওই ভবনকে আবাসিক কাজেই ব্যবহার করতে হবে, অন্য কোনো কাজে যেমন বাণিজ্যিক বা ব্যবসার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
এ নিয়ম না মানলে প্রতিবেশীরা নিতে পারে আইনের আশ্রয়। তারা যদি এমন কোনো ভবনের বিষয়ে অভিযোগ করে তাহলে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ওই ভবন ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে। মনে রাখতে হবে, ভবন বা ভবনসংলগ্ন রাস্তা বা এর সঙ্গে সংযোগকারী কমপক্ষে ৩ দশমিক ৬৫ মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন রাস্তার ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিন মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। মালিকানা উল্লেখ না থাকলে রাস্তা সর্ব সাধারণের রাস্তা হিসেবেই গণ্য হবে।
দুই রাস্তার সংযোগস্থলের কোণে এক মিটার জায়গা রাস্তা সরলীকরণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। কাছের কোনো রাস্তার কেন্দ্র থেকে কমপক্ষে সাড়ে চার মিটার অথবা রাস্তাসংলগ্ন সীমানা থেকে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরে ভবন নির্মাণ করতে হবে। অর্থাৎ ভবন বানাতে গিয়ে কোনোভাবেই প্রতিবেশীদের অধিকার ক্ষুন্ন করা যাবে না।
কোনো আবাসিক স্থানে ১০ শয্যাবিশিষ্ট ক্লিনিক, ব্যাংক, ফাস্টফুড রেস্তোরাঁ, দোকান, সেলুন, চিকিৎসকের চেম্বার, ঔষধালয়, সংবাদপত্র বিক্রয়কেন্দ্র, ফুলের দোকান, গ্রন্থাগার, নার্সারি স্কুল, লন্ড্রি ও দরজির দোকানের জন্য ভবন নির্মাণ করা যাবে। তবে এ রকম দালান কেবল দুটি রাস্তার সংযোগস্থলে নির্মাণ করা যাবে, যার মধ্যে একটি রাস্তা কমপক্ষে ছয় মিটার প্রশস্ত হতে হবে।
ইচ্ছা করলেই প্রতিবেশীর জায়গার ওপর কিংবা রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করা যাবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য প্রতিটি ভবনে কমপক্ষে ২৩ বর্গমিটার জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। আর বাণিজ্যিক স্থানে সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। ভবনের ছাদ এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে ওই ছাদের পানি রাস্তায় বা অন্যের জমিতে কিংবা ভবনে না যায়। ছাদ বা কার্নিশ উন্মুক্ত স্থানের ওপর আধা মিটারের অর্ধেকের বেশি বাড়ানো যাবে না। ভবনের দরজা ও জানালার ওপর হাফ মিটার প্রস্থের বেশি সানশেড নির্মাণ করা যাবে না।
ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরে কার্যকর রয়েছে মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনগুলোতে রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ। প্রতিবেশীর বাসার সামনে ইচ্ছা করলেই পশু জবাই করা যাবে না। অনুমোদিত স্থান ছাড়া পশু জবাই করা এবং কাটাকাটি করা যাবে না। আপনার বাসার ময়লা-আবর্জনা ইচ্ছা করলেই যেখানে-সেখানে ফেলে রাখতে পারবেন না। ইচ্ছা করলেই এমনভাবে থুতু বা পানের পিক ফেলতে পারবেন না, যাতে প্রতিবেশীদের গায়ে পড়ে কিংবা চলাচলে সমস্যা হয়। ফেলতে হবে নির্ধারিত স্থানে। রাস্তার ধারে যেখানে-সেখানে ইচ্ছা করলেই মলমূত্র ত্যাগ করা যাবে না। আপনার মন চাইলেই কোনো বিশেষ দিন উপলক্ষে প্রতিবেশীর বাসার সামনে কিংবা এলাকার রাস্তায় সংগীত, কৌতুক বা যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে না। রাস্তায় কিংবা কোনো প্রকাশ্য স্থানে কাপড় ধোয়া যাবে না এবং গোসল করা যাবে না। কোনোভাবেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করা যাবে না। উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে প্রমাণিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছর পর্যন্ত সাজা দিতে পারেন। আপনি ইচ্ছা করলেই অনুমোদন না নিয়ে যখন-তখন প্রতিবেশীর বাসায় ঢুকে পড়তে পারবেন না। আপনার পালিত কোনো পশু-পাখি রাস্তায় ছেড়ে রাখতে পারবেন না। প্রতিবেশীর বাসার দালানে কোনো পোস্টার বা বিজ্ঞাপন লাগানো যাবে না। সমাজে চলতে গেলে এসব বিধিনিষেধ আপনাকে মেনে চলতেই হবে। যদি না মানেন, তাহলে কমপক্ষে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হতে পারে এবং এর সঙ্গে থাকা লাগতে পারে জেলেও। আইন অনুযায়ী কোনো ক্ষতিগ্রস্থ বা বিরক্তির শিকার প্রতিবেশী পুলিশের কাছে লিখিত প্রতিকার চাইতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিবেশীর অধিকার রয়েছে টর্ট আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের মামলা করারও।
কেস ষ্টাডি-২। আরিফ মিয়া দীর্ঘদিন একটি রাস্তা ব্যবহার করে আসছেন। বাড়িতে যাওয়ার জন্য এটিই তার একমাত্র পথ। কিন্তু আরিফ মিয়া যে রাস্তাটি ব্যবহার করছেন তা এলাকার জমিওয়ালা জোতদার জলিল বিশ্বাসের। জমিওয়ালা একদিন চলাচলের এ পথ বন্ধ করে দিলেন। এখন কী করবেন প্রতিবেশী আরিফ মিয়া? সহজ উত্তর আইন অনুযায়ী জলিলের জায়গা হওয়া সত্ত্বেও আরিফ কিন্তু এই রাস্তায় চলাচলের সুবিধা পাবেন।
একটা নিদির্ষ্ট সময় পযর্ন্ত আপনি যদি তার এই সুখাধিকার উপভোগে বাঁধা দিয়ে না থাকেন, তবে একটা সময় তিনি এই সুখাধিকার দাবি করতে পারবেন এবং আপনি কোনোক্রমেই তাকে সেই অধিকার থেকে বাঁধা দিতে পারবেন না। তামাদি আইনের ২৬ ধারায় দীঘির্দন ব্যবহারের ফলে সুখাধিকার কীভাবে শক্তপোক্তভাবে তৈরি হয়, তার নিয়ম-কানুন বলা আছে। এই ধারা অনুসারে, আলো, বাতাস, রাস্তা, জলাধার, পানির ব্যবহারের ওপর জনগণের বা কোনো নিদির্ষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবগের্র সুখাধিকার তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে যারা সুখাধিকার দাবি করছেন, তাদের আদালতের কাছে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি প্রমাণ করতে হবে:
১. তারা দীঘির্দন ধরে এই অধিকারগুলো শান্তিপূণর্ভাবে, উন্মুক্তভাবে ব্যবহার করে আসছেন
২. তারা অধিকার হিসেবেই এগুলো উপভোগ করে আসছেন এবং তাদের এই উপভোগে মালিক কতৃর্ক কোনো বাঁধা দেয়া হয়নি
৩. তারা এই অধিকারগুলো সরকারি জমির ক্ষেত্রে ৬০ বছর এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমির ক্ষেত্রে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উপভোগ করে আসছেন
৪. বিশ বছর বা বারো বছর এভাবে সুখাধিকার উপভোগ করার পর পরবতীর্ দুই বছরের মধ্যে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে সুখাধিকার দাবি করতে হবে।
এই বিষয়গুলো প্রমাণ করতে পারলে, যারা সুখাধিকার দাবি করছেন, আদালত তাদের অনুকূলে সুখাধিকার ভোগের রায় প্রদান করবে। তবে যার সম্পত্তিতে এই সুখাধিকার দাবি করা হচ্ছে, তিনি যদি ২০ বছরের মধ্যে একটি দিনেরও প্রমাণ দিতে পারেন, যেদিন তিনি এই অধিকারগুলো উপভোগে বাঁধা দিয়েছেন, তাহলে সুখাধিকার দাবিকারীদের আবেদন অগ্রাহ্য হবে। দেওয়ানি আদালতে এই সুবিধা আদায়ের প্রতিকারের পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞাও চাওয়া যেতে পারে।
সুখাধিকার বা ইজমেন্ট নামে একটি বিষয় আইনে আছে। ১৮৮২ সালের সুখাধিকার আইন নামে আরও একটি আইন রয়েছে। বিল্ডিং কোডেও বিধিনিষেধ রয়েছে। আবার তামাদি আইনেও এ নিয়ে বলা আছে। এসব বিধিবিধান মেনে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেই তবে প্রতিবেশীকে বাড়ি নির্মাণ করতে হয়।
১৮৮২ সালের পথাধিকার অধিকার আইনের ৪ ধারার একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। হোসেন মিয়া কোন এক বাড়িরর মালিক। তিনি তার প্রতিবেশী রুহুল আমিনের জমির উপর দিয়ে কোন একটি নলকুপ হতে পানি আনার সুযোগ ভোগ করেন। এটাই পথাধিকার বা ইজমেন্ট রাইট।
কখন এ অধিকারের বিলুপ্তি ঘটে:
১। মালিক যদি নিজেই উক্ত স্বত্বের উপর তার অধিকার হারায়, তবে জনসাধারণের পথাধিকার লোপ পাবে।
২। যে ক্ষেত্রে কোন পথাধিকার নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য প্রদান করা হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে পথাধিকার বিলুপ্ত হবে।
৩। মালিক নিজের সংরক্ষিত ক্ষমতার বলে পথাধিকার বাতিল করলে অধিকার বিলুপ্ত হবে।
৪। প্রয়োজনের নিমিত্তে পথাধিকার সৃষ্টি করা হলে সে ক্ষেত্রে উক্ত প্রয়োজন শেষ হলে পথাধিকার লোপ পাবে।
৫। সুবিধাভোগী বা সেবক স্বত্বের মালিক একই ব্যক্তিতে পরিণত হলে পথাধিকারটি লোপ পাবে।
৬। সুবিধাভোগী বা সেবক স্বত্বের কোন একটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হলে পথাধিকারটি লোপ পাবে।
৭। কোন পথাধিকার অবিচ্ছিন্ন এবং একাধিক্রমে ২০ বছর কাল ভোগ করা না হয়ে থাকলে পথাধিকারটি লোপ পাবে ইত্যাদি।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮