বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: কবির ভাষায়-“মানবকুলে জন্ম নিলে কি সবাই মানুষ হয়/আদর্শ মানুষ জন্ম দেয় আমাদের বিদ্যালয়।” পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দিয়ে শুধু লালন-পালন করেন কিন্তু সেই সন্তান আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে শিক্ষকের সাহচর্য লাভ করে।
একজন আদর্শ শিক্ষক তিনিই, যাঁর শিক্ষা ও স্মৃতি দীর্ঘকাল শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে থাকে। তেমনি একজন অনুপ্রেরণাদায়ক শিক্ষক মোঃ তোয়াক্কেল আলী। খোকসার ঐতিহ্যবাহী ও স্বনামধন্য ‘খোকসা জানিপুর বহুমুখী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়’ এর সাবেক সিনিয়র শিক্ষক। দীর্ঘকাল পর আমার পেশাগত কর্মস্থল কুষ্টিয়া জজ কোর্টে স্যারের সাথে দেখা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও এখনও মনোবল রয়েছে দৃঢ়। ক্লাস সেভেনে ‘ইডিয়মস এন্ড ফেরেজ’ পড়ানোর কথা স্যারকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। একগাল হেসে দিলেন। স্যারের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা আর বেত্রাঘাতের ভয়ে এতো ফ্রেজ মুখস্ত করেছিলাম যে, তৎকালীন বাজারে প্রচলিত হাইস্কুল পর্যায়ের সকল গ্রামার বইয়ে সন্নিবেশিত ফ্রেজ আজও আমার মনে আছে। এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ থাকে না। কিন্তু একজন ভালো শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হলো, বিষয়টির সঙ্গে তিনি শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে ফেলেন। শিক্ষার্থীরা চাইলেও আর সেখান থেকে বের হতে পারে না।
মানুষের জীবনের একটি সময়ে কোনো না কোনোভাবে শিক্ষকের ভূমিকা একটু হলেও থাকে। ঠিক তেমনিভাবে আমার জীবনেও আছে। এমন একজন শিক্ষক যার অনুপ্রেরণা আশীর্বাদ ও ভূমিকার কথা প্রতিনিয়ত মনে পড়ে। আমি ইংরেজি পত্রিকায় লেখালেখি করি। বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত ও স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকার নাম ‘দি ডেইলী অবজারভার’। কষ্টের সাথে জানাতে হয় যে, গত পাঁচ বছর এ পত্রিকাটি আমার কোনো লেখা এডিট করে না। আমি যা লিখি, তা হুবুহু ছেপে দেন। মনে হয় স্যারের শেখানো ইংরেজি নির্ভূল লিখতে পেরেছি।
সেই স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই এবং সেখান থেকেই আমি এসএসসি পাস করি। আমাদের স্কুলের সাথে ছিল বিশাল খেলার মাঠ। আলতাফ স্যার ছিলেন তখন প্রধান শিক্ষক। ছিলেন অঙ্কের জাহাজ নামে খ্যাত রমেন স্যার ও মনোয়ার স্যার। যে কোনো ধরনের জটিল সমস্যা স্যাররা মুহূর্তেই সমাধান করে দিতেন। ইংরেজি পড়াতেন মোঃ সুলতান হোসেন স্যার ও মোঃ তোয়াক্কেল স্যার। আরও অনেক শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ছিলেন। তবে স্কুলে কোনো শিক্ষিকা ছিলেন না।
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা গদ্য ও ব্যাকরণ পড়াতেন আমার সবচেয়ে প্রিয় স্যার বাবু হিরন্ময় বিশ্বাস। স্যার কী অসাধারণভাবে বাংলা পড়াতেন আর ব্যাকরণ শেখাতেন তা সেই সময়কার সকল ছাত্র-ছাত্রীরাই বিনা বাক্যে স্বীকার করবেন।
স্যারের গরন ছিল দোহারা লম্বা। গায়ের রং ছিল শ্যামল বর্ণের। ভদ্র ও মার্জিত অবয়ব। কণ্ঠে গমগমে ক্ষুরধার আওয়াজ। কথা বলতেন খুব গুছিয়ে। তিনি কখনো বেত হাতে ক্লাসে আসতেন না। তবে স্যার চোখে কম দেখতেন।
ক্লাস সিক্সে মনোয়ার স্যার একদিন আমরা কেউ বাড়ির কাজ করে আসিনি বলে রাম ধোলাই দিয়েছিলেন।
তোয়াক্কেল স্যার ক্লাসে আসতেন একটা টেষ্ট পেপার বই হাতে নিয়ে। ক্লাসরুমে ঢুকলে আমরা সকলেই ভয়ে থরকম্প হয়ে থাকতাম। অথচ স্যার কী যে চমৎকার করে পাঠ বোঝাতেন এবং উপমা উদাহরণসহ ইংরেজি ব্যাকরণ শেখাতেন আমাদের কাছে তা দুর্বোধ্য মনেই হতো না।
আমরা কীভাবে ভালো করে শিখব কেমন করে জানব সেই চেষ্টা সব সময় করতেন তিনি। স্যারের ছিল শেখানোর প্রতি অনেক আগ্রহ।
স্যার ছিলেন ভীষণ মটিভেশনাল ও জ্ঞানী। রিডিং-লার্নিং ও তারপর টিচিং এই ছিল স্যারের পদ্ধতি। তিনি চাইতেন অন্যান্য শিক্ষকেরা আগে নিজে ভালো করে শিখে ছাত্রদের শিক্ষা দিক। আবার আশা করতেন তাঁর ছাত্ররাও ঠিক এ রকমই যেন হয়।
তখনকার সময়ে প্রায় গ্রামের স্কুল বলে অনেক ছাত্ররা লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ত। স্যার খুব চিন্তা করতেন তাদের নিয়ে। সে সব ছাত্রদের মা বাবার সঙ্গে দেখা করে বোঝাতেন।
আমি এসএসসির সময় একজন নরমশরম ভালো ছাত্রই ছিলাম। আমার ইংরেজি হস্তাক্ষর স্যারের খুব পছন্দ ছিল। হাতের লেখা প্রসঙ্গে এক ঘটনা এখানে না বললেই নয়।
হঠাৎ আমাদের স্কুলে উন্মুক্ত প্রোগ্রাম খুলল। আমার এক বন্ধুর মা উন্মুক্ত প্রোগ্রাম থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। বন্ধুর অনুরোধে ওর মা’র জন্য কিছু উত্তর লিখে দিলাম। আমরা দূরে হাইস্কুলের পুকুড়পাড় কৃঞ্চচূড়া গাছতলায় দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর দেখি তোয়াক্কেল স্যার আমাকে ইশারা করে ডাকছেন, সিরাজ এদিকে আয় তো।
আমি ধীর পায়ে স্যারের কাছে গেলাম। না জানি স্যার আমাকে কেন ডাকছেন।
আমার হাতের লেখার নকলের চিরকুটটা দেখিয়ে স্যার বললেন, এটা কার হাতের লেখা?
আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম।
স্যার শুধু বললেন, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাবি না হলে থাপ্পড়ে সব দাঁত ফেলে দেব।
এই হলো আমার প্রিয় স্যার।
আমাকে স্যার খুব স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন।
আমিও স্যারকে ভয় করতাম আবার সম্মাানও দেখাতাম।
স্যার কিন্তু গুরু শিষ্যর মতো একটা আলাদা দূরত্ব বজায় রেখে আমাদের সঙ্গে স্নেহমাখা মমতায় সুন্দর করে কথা বলতেন। বুদ্ধি পরামর্শ দিতেন।
এরপর স্কুল পেরিয়ে কলেজ। কলেজ ডিঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, বিদেশ। কর্মজীবনে প্রবেশ। পেশাগত কাছে দেশ ও বিদেশে নানান ধরনের শিক্ষকের সাক্ষাৎ পেয়েছি। কিন্তু সেই গ্রামের স্কুলের শ্রদ্ধেয় তোয়াক্কেল স্যার, সুলতান স্যার, মনোয়ার স্যার, মতিন স্যার, হিরন্ময় স্যারদের মতো শিক্ষককে আর পাইনি।
আজ শুধু মনে পড়ে যে, বাংলা ও ইংরেজি যা পড়েছি বা শিখেছি কিংবা আজকাল কলমের আঁচড়ে অপরিপক্ব হাতে যা লিখছি তার কৃতিত্ব সবটুকু পরম ওই সকল স্যারদের প্রতি।
পরম করুণাময় যেন এসকল শিক্ষাগুরুদের সবচেয়ে মহিমান্বিত স্থানে অধিষ্ঠিত করেন।
শিক্ষকতা পেশা হলো পৃথিবীর সমুদয় পেশার মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও শ্রেষ্ঠ। এ মহৎ পেশার দরুন একজন শিক্ষক মানুষের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকেন। কালের আবর্তনে শিক্ষকদের প্রদত্ত অবদান ক্ষয় হয় না। তাদের পাঠদানের প্রতিদান প্রবহমান থাকে অনন্তকাল। তারা মরেও অমর। সওয়াবের ধারাবাহিকতায় শিক্ষকদের আত্মা শান্তি পায়। কারণ একজন শিক্ষকের জ্ঞান দ্বারা অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর উপকার সাধিত হয়। এ উপকারই শিক্ষকের জন্য সদকায়ে জারিয়ার রোপিত বীজ।
এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন মানুষ মরে যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমলের সওয়াব বন্ধ হয় নাÑ ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. জ্ঞানÑ যার দ্বারা লোকের উপকার সাধিত হয়, ৩. সু সন্তানÑ যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম : ৪৩১০)।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, বিশিষ্ট কলামিস্ট, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮