এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: মানব জাতির শুরু থেকেই নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে এবং পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশী এ সমস্যা বিদ্যমান। তবে যুগে যুগে এর ধরণ ও রুপ পাল্টিয়েছে এবং ব্যাপকতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সেকারণ এ সমস্যাগুলো দমন করে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছে। আইনের ভাষায়, নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হলে অপরাধ প্রমাণ করার সবচেয়ে গুরুত্বপূূর্ণ ও কার্যকর প্রমাণ হিসেবে ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্রকে বিবেচনা করা হয়। বাস্তবে নারী ও শিশুদের ওপর শারীরিক নির্যাতন প্রতিকারে মেডিকেল পরীক্ষার ব্যবস্থা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সহায়ক নয়। আইন বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার জন্যই নির্যাতিতরা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে একদিকে যেমন বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে অপরাধীরা উৎসাহিত বোধ করে।
তেমনি নির্যাতিতা নারী অলিভিয়া (ছদ্মনাম)। গত ১৫ মে’২০১৯ স্বামী কর্তৃক চরমভাবে শারিরীক নির্যাতনের শিকার হয়ে পরদিন ভর্তি হন দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্রে । দুদিন ধরে চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে সোজা চলে যান থানায় স্বামী ও অন্যান্য নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ নির্যাতিতা নারীর কথা আমলে নেননি। প্রভাবশালী স্বামীর হুমকি-ধামকি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের আপোষ মীমাংসার স্তবক বানী শুনিয়ে নির্যাতিতা নারীকে দমিয়ে রাখা হয়। অবশেষে নির্যাতিতা নারী আসে বিচারের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল আদালতে। গত ২৫ জুন’ ২০১৯ ইং তারিখে কুষ্টিয়ার বিজ্ঞ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যাল আদালতে মামলা দাখিল করা হয়। কিন্তু বিধিবাম! আদালতের বিজ্ঞ বিচারক সময় বেঁধে দেন মাত্র ৭ দিন। এ সময়ের মধ্যে চিকিৎসা সনদ আদালতে দাখিল করতে হবে। মেয়েটি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান দৌলতপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্ের। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সাফ কথা পুলিশ কিংবা আদালত না চাইলে কোনভাবেই চিকিৎসা সনদ দেবেন না। এমনকি চিকিৎসা সনদ পেতে মেয়েটির আবেদন পর্যন্ত গ্রহন করেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত ডাক্তার বাবু। নির্যাতিতা নারী অলিভিয়া জানান, আমি তিনদিন ধরে হাসপাতালের বারান্দায় দাড়িয়ে আরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের টিজের শিকার হয়েছি। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩২ ধারায় ষ্পষ্ট বলা আছে যে, অপরাধের শিকার ব্যক্তির মেডিক্যাল পরীক্ষা শেষে একটি চিকিৎসা সনদ প্রদান করবেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০০২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর জারিকৃত পরিপত্রে ধর্ষণ কিংবা এসিড বা এ জাতীয় অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও ডাক্তারী পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধান কার্যকর করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'পুলিশের রেফারেন্স ছাড়াও ধর্ষণ এবং অন্যান্য সহিংসতার শিকার কোনো নারী ও শিশু যে কোনো সরকারী স্থাপনায় কিংবা সরকার কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোনো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তাৎক্ষণিকভাবে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে যথানিয়মে পরীক্ষা করবেন এবং মেডিকেল সার্টিফিকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও নিকটস্থ থানায় প্রেরণ করাসহ, যাকে পরীক্ষা করবেন তাকেও ১ কপি প্রদান করবেন। চিকিৎসক ও তার ক্লিনিক্যাল সহকারীরা নির্যাতনের নারী বা শিশুকে যথাসাধ্য সেবা দেবেন।
কিন্তু উপরে উল্লিখিত অলিভিয়া (ছদ্মনাম) গল্প থেকে সহজেই অনুমেয়, এ নির্দেশনা মোটেই অনুসৃত হচ্ছে না। প্রথমত, নির্যাতনের শিকার কেউ হাসপাতালে গেলে থানার রেফারেন্স ছাড়া কর্তব্যরত ডাক্তার মেডিকেল পরীক্ষা করতে রাজি হন না। দ্বিতীয়ত, যাকে পরীক্ষা করছেন 'তাকেও' মেডিকেল সার্টিফিকেটের কপি কোনো অবস্থাতেই সরবরাহ করা হয় না। এর কোনো কারণই সুস্পষ্ট নয়।
তবে 'নির্যাতনের শিকার বা তার পরিবারে কারও হাতে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রদান করা কেন সম্ভব নয়- এ ধরণের প্রশ্নে ডাক্তারদের স্পষ্ট জবাব ' আমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে?' অর্থাৎ নির্যাতনের শিকার ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট জেনে গেলে, তিনি ধরে নিচ্ছেন, সংশ্লিষ্ট ডাক্তার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাবেন। তাহলে কে বা কারা এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি, সেটাও স্পষ্ট হওয়া দরকার।
তবে আইন বলছে, মেডিকোলিগ্যাল দায়িত্ব পালন করতে পারেন ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় কর্মকর্তা, জেলা হাসপাতালের আরএমও এবং মেডিকেল অফিসার ও নির্দিষ্ট কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা করার যোগ্যতাসম্পন্ন ডাক্তার উপজেলা পর্যায়ে তো আছেই, এমনি অনেক ইউনিয়ন পর্যায়েও আছে। উপজেলা পর্যায়ে মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষার উপকরণও আছে। সুতরাং এ জাতীয় পরীক্ষা উপজেলা হাসপাতাল থেকে করে সার্টিফিকেট দিতে আইন বাধা তো নেই-ই, বরং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে। কিন্তু নির্দেশনা কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেই। তবে দেশের সরকারী চিকিৎসালয়গুলোতে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অন্যান্য ছুটির দিন এবং কর্মদিবসগুলোতে দুপুর ২টার পর কোনো চিকিৎসক খুঁজে পাওয়া যায় না, মেডিকোলিগ্যাল পরীক্ষা তো দূরের কথা। গ্রাম পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে দূরত্ব, যানবাহন, অর্থ সংকট ইত্যাদি কারণে এবং বহুদূর থেকে জেলা সদরে এসে হাসপাতালে ডাক্তার অনুপস্থিত থাকার কারণে ডাক্তারী পরীক্ষা সময়মতো একেবারেই সম্ভব হয় না। ফলে স্বভাবতই নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, অপরাধ উৎসাহিত হয়। আমরা আশা করতে চাই, আইন, নীতিমালা, নির্দেশনা, অবকাঠামো ইত্যাদির সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে নারী ও শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনসহ সব ধরনের নির্যাতন বন্ধে ডাক্তার, পুলিশ সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। নির্যাতিতা অলিভিয়ারা যেনো সঠিক বিচার পায়-এই হোক প্রত্যাশা।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com