এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আমার এ দীর্ঘ দু’যুগের সাংবাদিক জীবনে কত যে স্মৃতি জমা হয়ে আছে, তার যেন শেষ নেই। কত যে ভালো-মন্দ বড় বড় ঘটনার সাক্ষী আমি, সেসব আজ ইতিহাস। কত বড় গুণিজনের সান্নিধ্যে সময় কেটেছে, তাদের কথা মনে পড়ে কখনো কখনো। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো অনেক স্মৃতিই যাচ্ছেন বিস্মৃতির অতলে। তবে ঘটে যাওয়া বড় ধরনের অনেক ঘটনার কথা এখনো অনেকে জানতে চান কখনো কৌতূহলবশত।
সংবাদ ৬৯ বছরে পা দিয়েছে। যখন আমি খবরের কাগজ অল্প অল্প পড়তে পারি তখন থেকে সংবাদ পড়ি। অর্থাৎ সংবাদ পড়ার মাধ্যমে আমার খবরের কাগজ পড়া শুরু এবং অভ্যাসটা হয়। সংবাদ পড়ার এ সুযোগটা হয় পারিবারিক কারণে। আমার বাবার গদিঘরে তখন সংবাদ রাখা হতো। ২০০০ সালের দিকে আমি সাংবাদিক হিসেবে সংবাদের সঙ্গে যুক্ত হই। ওই সময় রিপোর্ট হাতে লিখে পাঠাতে হতো। একটু জরুরি হলে ফোন, ফ্যাক্্র কিংবা সংক্ষিপ্ত আকারে টেলিগ্রাম করতাম। প্রযুক্তির উন্নয়নে সে অবস্থা কেটে পরে টেলিপ্রিন্টার, ফোন, ফ্যাক্স ও সর্বশেষ ই-মেইল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। টেলিফোনে সংবাদ পাঠানোর বিড়ম্বনাও ছিল যথেষ্ট। এখন যেমন টেলিফোনের উন্নয়ন হয়েছে তখন তেমনটা ছিল না। চিৎকার করে এ প্রান্ত থেকে কথা বলতে হতো। তারপর দেখা যেত কুমারখালীর জায়গায় কুমারকলী, খোকসার স্থলে খেকসা, জিলাপীতলার জায়গায় জিগাতলা ছাপা হয়েছে।
২০০২ সাল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রাজ্য ক্ষমতায়। চলছে ক্লিনহার্ট অপারেশন। বিনা বিচারে মানুষ হত্যার প্রহসন। কুষ্টিয়ার খোকসায় রয়েছে কমলাপুর নামে একটি গ্রামে। এ গ্রামে রয়েছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের মেস। গ্রামবাসীর অভিযোগ-এখানে ছাত্র শিবিরের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এক রাতে এই মেস থেকে ষোড়শী যুবতীর কান্নার শব্দ শুনতে পান এলাকাবাসী। যুবতীর অভিযোগ এই মেসের ছাত্রদের দ্বারা তিনি গণধর্ষনের শিকার। পরদিন সংবাদের প্রথম পাতায় শিরোনাম “কুষ্টিয়ার খোকসায় শিবির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এক যুবতী গণধর্ষনের শিকার।” সারাদিন নিউজটি এলাকায় চাউর হয়ে উঠেছে। ক্লান্ত দেহ। রাতে নিউজ এর কাজ করে সবেমাত্র ঘুমিয়েছি। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। সেনা সদস্যদের বুটের শব্দ। আমি ক্যাপ্টেন অমোক বলছি। দরজা খুলুন।
সবে মাত্র বিয়ে করেছি। এখনও স্ত্রীর হাতে মেহেদীর রঙ শুকায়নি। প্রিয়তমা স্ত্রী ভয়ে দুরুদুরু। কিন্তু দরজা তো খুলতেই হবে। শার্ট-প্যান্ট পরে দরজা খুলে দিলাম। একজন কমান্ডিং অফিসার সংকেত দিয়ে কি যেন বললেন। বলার সাথে সাথে আমার চোখ দুটি বেঁধে ফেলা দেয়া হলো। এরপর নিয়ে যাওয়া হলো ডাকবাংলোতে। সেখানে রাতভর চলল মানসিক নির্যাতন। অবশ্য এ যাত্রাতে বাদ পড়েনি সেসময়ের দৈনিক আজকের কাগজের প্রতিনিধি ও খোকসা প্রেসক্লাবের সভাপতি মুন্সী লিটন।
স্মৃতিতে সমৃদ্ধ সংবাদে আমার কর্মজীবন। আমি এখন কলাম লিখি। সপ্তাহে অন্তত দুটি কলাম তো লিখিই। লেখাগুলো কেমন হয় তার বিচারের ভার পাঠকের ওপর। যেদিন লেখাটি সংবাদ প্রকাশ করে সেদিন পত্রিকাও কুষ্টিয়া বেশি বিক্রি হয়। সংবাদে রিপোর্ট করতে গিয়ে জেলের ভাতও খেয়েছি। পুলিশের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে সরকারী কাজে বাঁধা প্রদানের অভিযোগ এনে আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অবশ্য সেসময়টি ছিল ২০০৭ সালের ২৫ জুন। তত্বাধায়ক সরকারের আমল। ইয়াজউদ্দিন-ফকরউদ্দিন-মইনইউ আহমেদের আমল। তবে বেশিক্ষণ থাকতে হয়নি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ২৪ ঘন্টার মধ্যে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন।
‘সংবাদ’-এ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কাফনের কাপড় পেয়েছি। পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টির খোকসা-কুমারখালী অঞ্চলের একদিলের নাম অনেকেই শুনে থাকবেন। অবশ্য যাদের কারণে এ অবস্থা হয়েছিল তারা পরবর্তীতে ক্রসফায়ারে (সন্ত্রাস দমনে এ পদ্ধতিটি মোটেই পছন্দ নয়)। এ রকম অসংখ্য কাহিনী আছে যা লিখতে গেলে কলেবর বাড়বে। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। তবে আগামীতে লেখার ইচ্ছা আছে।
সংবাদ-ই আমাকে দ্রোহী হতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে মানুষের কথা বলতে, ন্যায়নিষ্ট সংবাদ লিখতে, পক্ষপাতহীন খবর লিখতে। শিখিয়েছে মানুষের কাছে, মাটির কাছে যেতে। ‘সংবাদ’ই আজ আমাকে এখানে এনেছে, সংবাদই আমাকে তিলে তিলে তৈরি করেছে। আর এজন্যই বহু পত্রিকায় কলাম লেখার সুযোগ সত্ত্বেও সংবাদ ছাড়তে পারিনি।
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com