সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:২২ পূর্বাহ্ন
সিরাজ প্রামাণিকঃ ‘আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বাঁচতে চাই। জীবনে শত কষ্টের মাঝে এই ভেবে সান্তনা পাই যে, আমার বাবা একজন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এটুকু আশা নিয়ে আজও বেঁচে আছি’-কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন কুষ্টিয়া জজ কোর্টের তরুণ আইনজীবী ও এপিপি মনোয়ারুল ইসলাম (মনিরুল)। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি এ পরিবারটি।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম। ৩০ বছরের টগবগে যুবক। বামপন্থী রাজনীতিক। রেনউইক এন্ড যজ্ঞেশ্বর কোম্পানীর সিবিএ নেতা। কুমারখালীর মনোহরপুর গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ইয়াজউদ্দিন মোল্লার পুত্র। চারদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঢামাঢোল। টগবগে এ যুবকের নেতৃত্বে এলাকার মুক্তযোদ্ধারা সংগঠিত। ১৪ আগষ্ট, ১৯৭১। একজন ইপিআর সদস্যের পিতাকে স্থানীয় রাজাকাররা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এ খবর শুনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ কানে বেজে উঠে এ যুবকের। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে রাজাকারদের উপর। রাজাকাররা গুলি চালিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা এ পরিবারটির উপর। মনোহরপুর গ্রামের মজনু মেম্বরের বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় শহীদ হন পিতা-পুত্র। আরেক ভাই নজরুল ইসলাম দেহে তিনটি গুলি খেয়েও বেঁচে যায়। বছর তিনেক আগে তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন।
আমিনুল ইসলামদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন। কুষ্টিয়ার তৎকালীন মাননীয় জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে এ শহীদ পরিবারে দুই হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিলেন। তারপর দীর্ঘ ৪৮ বছর কেটে গেল এ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে কেউ খবর রাখেনি। এমনকি এ পরিবারটি আজও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবেও স্বীকৃতি পায়নি।
রাজাকার বাহিনীর সাথে সন্মুখযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম সম্পর্কে কুমারখালী সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল ইসলাম নুরু জানান, রাজাকারদের হাত থেকে ইপিআরর সদস্যের পিতাকে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন পিতা পুত্রকে রাজাকারদের হাতে প্রান দিতে হয়েছিল। ২০১৭ সালে উপজেলা যাচাই বাছাই কমিটি এ শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পেতে সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অদৃশ্য কোন কারণে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
রাষ্ট্রীয় ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আঃ মান্নান ও সোলাইমান জানান, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম ছিলেন সে সময়ের ৩০ বছরের টগবগে যুবক। আমাদের রনাঙ্গনের সাথী। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজাকারদের হাতে প্রাণ দিলেও আজও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া দুঃখজনক।
সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে যে তালিকা প্রকাশ করা হয় সেই তালিকাতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম ও তার পরিবারের নাম নেই। তালিকায় নাম না থাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তান কুষ্টিয়া জজ কোর্টের তরুণ আইনজীবী ও এপিপি মনোয়ারুল ইসলাম যুগপৎ হতাশ এবং বিস্মিত হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত বিভিন্ন বই, গবেষণা গ্রন্থ ও দলিল দস্তাবেজে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমিনুল ইসলামের নাম রয়েছে।
কুমারখালীর মনোহরপুর গ্রামের ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন খান জানান, আমিনুল ইসলামকে এখনো শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভূক্ত না করা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এতে তাঁর পরিবার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া বিশেষ আর্থিক সুবিধা ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ওই যুদ্ধে আমিনুল ইসলাম ও তার পিতা ইয়াজউদ্দিন মোল্লার শহীদ হন।
মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, মুক্তিযুদ্ধে তার বাবার জোরালো ভূমিকা ও রাজাকার কর্তৃক হত্যা হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা প্রণয়ন করা হয় তাতে তার পিতার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ বিষয়ে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি আরও বলেন, ‘জননেত্রীর কাছে এই সত্য তুলে ধরার পেছনে র্অর্থনৈতিক লাভ এবং অন্য কোন প্রকার সুবিধা প্রাপ্তির উদ্দেশ্য নয়, শুধুমাত্র একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে পিতার স্বীকৃতিটাই কেবল চাই, অন্যকিছু নয়। এই স্বীকৃতিটুক পেলে পিতার যথার্থ মূল্যায়নটা করা হবে।’