বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩০ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন কথিত অপহরণকারীর পিতা-মাতা অন্যদিকে উদ্ধারকৃত মেয়েটি। উভয় পক্ষের শুনানী চলছে। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মেয়েটি জবানবন্দি প্রদান করছেন। স্বেচ্ছায়, সুস্থ মস্তিষ্কে এবং অন্যের বিনা প্ররোচনায় মেয়েটি তার ভালবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে। বিচারক মেয়েটির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করছেন। মেয়েটির নাম সুদীপ্তি (ছদ্মনাম)। মাঝারি গড়নের, চিকন ও ফরসা। ডাগর ডাগর দুটি চোখ জুড়ে যেন তার ভালবাসার মানুষের প্রতিচ্ছবি। ওই দুটি সরল চোখই বলে দেয়, তার হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউ। জবানবন্দি শেষ হলো। এবার জেনে নেয়া যাক মেয়েটির হৃদয় গহীনে জমে থাকা কষ্টের কাহিণী।
অনেক সময় ছেলে-মেয়েরা তাদের ভালবাসাকে বাস্তবে রুপ দিতে একে অপরকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও আইনগত অধিকার তাদের আছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতে তারা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতে বাঁধ সাধে উভয় পরিবারের পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন। শেষমেশ বিষয়টি অনেক সময় থানা-কোর্ট কাচারীতে গিয়ে পৌঁছায়। তাতে কার কি লাভ হয়-এ কেইস স্টাডি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের পরিপাটি চেহারার ভদ্রলোক মামলা করেছেন থানায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া এক ছাত্রের বিরুদ্ধে। অভিযোগ হচ্ছে, ওই ছাত্র ভদ্রলোকের স্কুল পড়–য়া নাবালিকা মেয়েকে ফুসলিয়ে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। অপরাধ খুবই গুরুতর। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় ওই ছাত্র অপরাধ করেছে বলে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সহসা জামিনের আশা নেই। কারণ, প্রথমত জামিন অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত এ মামলায় জামিন শুনানী করার এখতিয়ার নিম্ন আদালতের নেই। সে কারণে অভিযোগকারী ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন আসামীকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে ওই ছাত্র বেচারা গা-ঢাকা দিয়েছে। বাড়িতে আছেন কেবল ওই ছাত্রের মা-বাবা এবং কথিত অপহরণ করা কিশোরী মেয়েটি।
মামলার এফ.আই.আর সহ মামলাটি আদালতে দাখিল করা হয়েছে। পুলিশ ওই আসামীর বাড়িতে তল্লাশী চালায় এবং আসামীর মা-বাবা এবং কথিত অপহরণ করা কিশোরী মেয়েটিকে উদ্ধার করে আদালতে সোপর্দ করে।
মেয়ের পিতা-মাতার দাবী তাদের মেয়ে অপরিণত বয়সের। ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা মেয়েটির হয়নি। তাই তারা মেয়েটিকে তাদের জিম্মায় দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। মেয়েটির বয়স কম সে বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য সরকার পক্ষ তথা মেয়ের বাবা মেয়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষক কর্তৃক সত্যায়িত একটি সনদপত্র এবং মেয়ের মায়ের একটি এফিডেভিট আদালতে দাখিল করেন। অন্যদিকে মেয়ের কথিত অপহরণকারী ওই আসামীর পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবীরা বলছেন, মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্কা, মুসলিম শরিয়াহ মোতাবেক তার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। এ অবস্থায় মেয়েকে তার ইচ্ছানুযায়ী স্বামীর গৃহে অবস্থানের অনুমতি দেয়া হোক এবং তার শ্বশুর-শাশুড়ির জিম্মায় মুক্তি দেয়া হোক।
উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক তাৎক্ষণিকভাবে মন স্থির করতে শঙ্কায় পড়ে যান। কিন্তু সিদ্ধান্ত তো তাকে দিতেই হবে। মেয়েটি কোথায় যাবে? পিতার গৃহে নাকি কথিত অপহরণকারীর বা স্বামীর গৃহে? এ পর্যায়ে তিনি মেয়েটির বক্তব্য শুনতে চান। মেয়েটি আদালতকে জানায়, আসামী তার স্বামী। তাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ে কাজী অফিসে রেজিস্ট্রি হয়েছে। সে তার স্বামীকে ভালবাসে। তাদের বিয়ে উভয় পক্ষের সম্মতিতে করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার স্বামী পারিবারিকভাবে তার পিতা-মাতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তার অহংকারী পিতা-মাতা বেকার যুবকের সাথে বিয়েতে রাজি হয়নি। তারা বাধ্য হয়ে নিজেরাই বিয়ে করেছে।
মেয়েটি আরও জানায়, তাকে তার পিতা-মাতার কাছে যেতে বাধ্য করলে তারা তাকে মারধর করবে, তার উপর অমানসিক নির্যাতন চালাবে এবং তাকে বাধ্য করবে স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে। একবার তার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিলে তার স্বামীর জেল হবে। এ অবস্থায় তার পিতা-মাতার সাথে যাওয়ার চেয়ে তার মৃত্যু হওয়ায় ভালো। এ ধরণের বক্তব্য আদালতে মেয়েটি উপস্থাপন করে। মেয়েটির এ বক্তব্য শোনার পর বিচারক কিছুটা বিভ্রান্ত হন। কি আদেশ দেয়া যায়? অবশেষে তিনি আদেশ দেন যে, ভিকটিমের (মেয়েটির) বয়স প্রমাণের পরীক্ষা করার জন্য ভিকটিমকে সিভিল সার্জনের কাছে প্রেরণ করা হোক। ভিকটিমের বয়স প্রমাণ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে জুডিশিয়াল কাস্টোডিতে তথা বিচার বিভাগীয় হেফাজতে রাখা হোক। বয়স প্রমাণের পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর এবং এ বিষয়ে সিভিল সার্জনের কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী আদেশ দেয়া হবে।
দুদিন পর মেয়েটির বয়স সম্পর্কে প্রতিবেদন পাওয়া গেল। মেডিকেল রিপোর্টে দেখা গেল মেয়েটির বয়স ১৫ হতে ১৬ বৎসরের মধ্যে, অন্যদিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক যে সনদপত্র দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েটির বয়স ১৫ বৎসর। আর মেয়েটির মা এফিডেভিট করে বলেছেন, তার মেয়ের বয়স ১৩ বছর। সব মিলিয়ে মেয়েটির বয়স যে কত তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় উভয় পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবীরা তাদের নিজ নিজ দাবীর পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিতে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছে বলে গন্য হবে না। ধর্ষণের এ সংজ্ঞা থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, ১৬ বছর বয়স যে কোন মেয়ের বিবাহের জন্য বিবেচনাযোগ্য একটি বয়স। পাশাপাশি ১৬-১৮ বছর বয়সের নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌন মিলনকে এ আইন স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বিচারক যে আদেশ দেন তা নিম্নরুপঃ
উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য, ভিকটিমের বয়স সম্পর্কিত প্রমাণাদি পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করা হলো। বিয়ের কাবিননামা দেখা গেল, সমাগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে এবং ভিকটিমের বক্তব্য পর্যবেক্ষণ করে আদালতের কাছে মনে হচ্ছে যে, ভিকটিমের বয়স ১৬ বছর অতিক্রম করেছে স¤ভাবনা বাদ দেয়া যায় না। তদুপরি তার বয়স নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং ঘটনা ও পারিপার্শি¦ক অবস্থা বিবেচনা করে আদালতের কাছে এটিও প্রতীয়মান হয়, ভিকটিম মেয়েটি নিজের ইচ্ছায় তার পিতা-মাতার ঘর ত্যাগ করেছে এবং ফিরে আসার কোন ইচ্ছা তার মধ্যে আপাততঃ দেখা যাচ্ছে না। তাই তাকে জুডিশিয়াল হেফাজত থেকে মুক্তি দেয়া হলো। তিনি স্বেচ্ছায় যেখানে যেতে চান সেখানে যেতে পারেন, স্বামীর গৃহে কিংবা পিতা-মাতার বাড়িতে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী এবং একজন উপযুক্ত স্থানীয় জামিনদারের জিম্মায় জামিনে থাকবেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ঊসধরষ:ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮