বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা। একসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এই গানটি বাজানো হতো নিয়মিত। লেখাটি লিখতে গিয়ে গানের কথাগুলি বারবার মনে পড়ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির (অ্যানরোলমেন্ট) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার পরও এক বিচারপতির ছেলেকে সরাসরি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে গেজেট প্রকাশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট শুনতে তৃতীয়বারের মতো অপারগতা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ অপারগতা প্রকাশ করেন। এর আগেও গত ২৬ নভেম্বর বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের এক দ্বৈত বেঞ্চ এবং বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মেস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ থেকেও রিটটি শুনতে অপারাগতা প্রকাশ করা হয়েছিল। তৃতীয়বারের মতো আদালত রিটটি শুনতে অপরাগতা প্রকাশ করায় মামলাটি আরেকটি আদালতে উত্থাপন করা বা প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবৃন্দ। রিট আবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পরীক্ষায় কয়েকবার অংশ নিয়েও কৃতকার্য হতে পারেনি হাইকোর্টের এক বিচারপতির ছেলে মো. জুম্মান সিদ্দিকী। অথচ গত ১৯ সেপ্টেম্বর জুম্মান সিদ্দিকীকে সরাসরি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে গত ৩১ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। রিটে ওই গেজেট এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অর্ডারের ২১(১)(খ) ও ৩০(৩) ধারা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। জুম্মান সিদ্দিকীসহ বার কাউন্সিলের সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়।
এই খবরটি বেশকিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে পত্রিকার কলাম পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে বিশেষ করে বিচারিক অঙ্গনে। উল্লেখ্য জজ কোর্টের এমসিকিউ পরীক্ষা বার কাউন্সিলের ব্যর্থতার কারণে বিগত দুই বছর অনুষ্ঠিত না হলেও সাধারণ মানুষের সন্তানরা শুধুমাত্র এমসিকিউ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার আকুল দাবীতে হাইকোর্টের সামনে একাধিকবার মানববন্ধন করেছে। অবশেষে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত না খেয়ে শান্তিপূর্ণ গণঅনশন করা অবস্থায় রাষ্ট্রের সন্ত্রাস বাহিনী কর্তৃক অত্যন্ত নির্মম ও জঘন্যভাবে তাড়িয়ে দেয়ার খবরও পাওয়া গেছে। অথচ এই হাজার হাজার অসহায় ল গ্রাজুয়েট যাদের অধিকাংশই ওকালতির সনদের অভাবে বেকার হয়ে বছরের পর বছর মানবেতর জীবন যাপন করছে।
আপীল বিভাগের ২০১৭ সালের রায়ে প্রতি বছর আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা নেওয়ার এবং সেই বছরেই তালিকাভুক্তি সম্পন্ন করার পরিস্কার নির্দেশ থাকার পরেও সেই আদেশের বিষয়ে বার কাউন্সিল আর এর সংশ্লিষ্ট আইনজীবী নেতারা বিন্দুমাত্র কেয়ার করেন না। কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় বিশেষ মানুষদের বিশেষ কারণে অনুমতি দেবার জন্য সাংঘাতিক অস্থির ও পরম ব্যাকুল হয়ে যান। প্রশ্ন উঠেছে বার কাউন্সিলের এইসব নেতাদের তোষামোদী কি শুধু ভিআইপিদের আর তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য ? তবে বার কাউন্সিলের সদস্য জেড.আই.খান পান্না সম্প্রতি নিজেকে জাহির করতে একটি সাংবাদিক সন্মেলনও করেছে। কিন্তু ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেনি। হালুয়া রুটির ভাগ ঠিকই নিতে ব্যস্ত সবাই। তাহলে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলতেই পারে যে বার কাউন্সিল কি শুধু বেছে বেছে ক্ষমতাবান আর তাদের ছেলে মেয়েদের সরাসরি হাইকোর্টের এডভোকেটশীপের লাইসেন্স দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই? আজ একজন বিচারপতির ছেলের সরাসরি হাইকোর্টের এডভোকেটশীপের সনদ, আগামীকাল অন্য কোনো বিচারপতির ছেলে মেয়ে, পরশু মন্ত্রী এমপিদের ছেলে মেয়ে, তারপর অন্য কোনো ক্ষমতাধর নেতা উপনেতার ছেলে মেয়ে, এইভাবে এর শেষ কোথায়?
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর একটি রিট অনেকের মাঝে কৌতুহল তৈরি করেছে। নিজের অধিকার ফিরে পেতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এই বিচারপতি। তাঁর নামে বরাদ্দ করা পাঁচ কাঠার প্লট বাতিলের নোটিশের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে রিট করেছেন। রিটের শুনানি শেষে আদালত রাজউকের দেয়া প্লট বাতিলের নোটিশের কার্যকারিতা স্থগিত করেছেন। পাঁচ মাসের স্থগিতাদেশে প্লটটি অন্য কারো নামে বরাদ্দ না দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর নামে রেজিস্ট্রিকৃত প্লটের বিপরীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তির ১২ লাখ টাকা গ্রহণ করতে রাজউককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্লটটি বাতিল করে রাজউকের দেয়া গত ৯ জুলাইয়ের নোটিশ কেন অবৈধ ও কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তির টাকা গ্রহণ করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে হবে। উল্লেখ্য, ৯ জুলাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীর নামে বরাদ্দকৃত উত্তরা-১৫ নাম্বার সেক্টরের, দুই নাম্বার সড়কের, ৯ নাম্বার প্লটের বরাদ্দ বাতিল করে। প্লট বরাদ্দের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী নিজেই রিটটি দায়ের করেন। ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি প্লটটি বরাদ্দ পেয়েছিলেন।
বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উঠেছে বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা দরকার। বিচারক নিয়োগে নীতিমালা করার বিধান বাহাত্তরের সংবিধানে ছিল না। ১৯৭৮ সালের ২০ আগস্ট জিয়াউর রহমান একটি সামরিক ফরমান দিয়ে সংবিধানে ৯৫(২) গ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে নীতিমালার বিধান আনেন। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।’ কিন্তু দীর্ঘ বছরেও এ আইন করা হয়নি। তবে ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই বিএনপি আমলে বাদ পড়া ১০ বিচারকের পুনর্নিয়োগ মামলার রায়ে হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ (বিচারপতি আবদুর রশীদ, এস কে সিনহা, নাজমুন আরা সুলতানা ও সৈয়দ জিয়াউল করিম সমন্বয়ে গঠিত) অভিমত দিয়েছিলেন, ‘বিচারক নিয়োগে গাইডলাইনের অনুপস্থিতি বিনা উদ্দেশ্যে নয় বরং সুচিন্তিত হতে পারে।’ এর পরে একই মামলায় আপিল বিভাগ (বিচারপতি এম এম রুহুল আমীন, মোহাম্মদ ফজলুল করিম, মো. তাফাজ্জাল ইসলাম, মো. জয়নুল আবেদীন এবং এম এ মতিন সমন্বয়ে গঠিত) ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিচারক নিয়োগে প্রথমবারের মতো একটি গাইডলাইন করে দেন। এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নেবেন এবং তাঁরা পরস্পর চিঠিপত্রের মাধ্যমে বা টেবিলে বসে পরামর্শ করতে পারেন। কিন্তু এই শলাপরামর্শের প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করতে তাঁদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনার রেকর্ড রাখতে হবে, যাতে বিরোধ বা মতানৈক্য দেখা দিলে কোনো দ্ব্যর্থকতা ছাড়াই তা নিরসন করা যায়।’ ২০১০ সালের ৬ জুন বিচারপতি মো. ইমান আলী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বিচারকের প্রার্থিতা বাছাইয়ে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, তা রাষ্ট্রকে জানাতে চার সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু অদ্যবধিও সরকার তার উত্তর দেয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত বন্ধ করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন আপিল বিভাগ। জানা গেছে, ২০১০ সালের ১৮ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য একটি নোটিশ ইস্যু করে দুদক। একই বছরের ২৫ জুলাই ওই নোটিশকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। কিন্তু হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাঁর সেই রিট আবেদন খারিজ করে দেন।
বিএনপি শাসনামলে ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার পর বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কমিটির সেই তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা রিপোর্টটি নাকচ করে দেন। আওয়ামী লীগ ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশও করে। অভিযোগ করা হয়, বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়ে বিচারপতি জয়নাল আবেদীন রিপোর্টটি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর নীতি নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নোটিশ করা হয় বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে। এরপরই তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুণাভ চক্রবর্তীর স্বাক্ষর করা ওই চিঠি দুদক ও সরকারের ভেতরে বিস্ময়ের জন্ম দেয়। চিঠিতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুদকের কোনো রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন হবে না বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে দুদকের তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের এমন হস্তক্ষেপকে একটি বিরল ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তাঁরা মনে করেন, এটি একটি ন্যায়বহির্ভূত হস্তক্ষেপ।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮