বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: বাংলা অভিধান অনুসারে অতি অল্প বয়স্ক, আট বা ষোল বছরের অনধিক বয়স্ক বালক-বালিকাকে শিশু বলে। বর্তমানে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ এর ২(৩) ধারা অনুযায়ী শিশু মানে ২১ বছরের কম বয়সী পুরুষ এবং ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোন নারীকে বোঝাবে। এই আইনের ২(৪) ধারা অনুযায়ী বিবাহের পক্ষদ্বয়ের কোন একপক্ষ যদি শিশু হয় তবে উক্ত বিবাহকে শিশু বিবাহ বলে আখ্যায়িত করা হবে। এই আইনের ৭ ধারা অনুযায়ী শিশু বিবাহের শাস্তি সম্পর্কে জেল, জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সাজা ও জরিমানার ধারণা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, শিশু বিবাহের যোগ্যতা অর্জন করতে হলে তাকে কারাদন্ড খাটার সাহস ও সামর্থ্য অর্জনই যথেষ্ট।
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছেন বলে গন্য হবেন।
উপরে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন এর ২(ক) ধারায় আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি যে, শিশু মানে ১৮ বছরের কম বয়সী যে কোন নারীকে বোঝাবে আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ২(ট) ধারা অনুসারে শিশু অর্থ অনধিক ষোল বৎসর বয়সের কোন ব্যক্তি এবং শিশু আইন ২০১৩ এর ৪ ধারা অনুসারে ১৮ বছর বয়সের নিচে সকল ব্যক্তিই শিশু। আবার শিশুনীতি, ১৯৯৪ অনুযায়ী ১৪ বছর পূর্ন হয়নি এমন সব ছেলেমেয়েকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
তাহলে আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে পাই যে, ১৬ বছর বয়স যে কোন মেয়ের বিবাহের জন্য বিবেচনাযোগ্য একটি বয়স। পাশাপাশি ১৬-১৮ বছর বয়সের নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌন মিলনকে এ আইন স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
অন্যদিকে ম্যাজরিটি এ্যাক্ট বা বাংলায় সাবালকত্ব ১৮৭৫ অনুসারে কোন বিষয়ে সম্মতি বা অসম্মতি প্রদানে কোন ব্যক্তির নূন্যতম বয়স বিবেচনা করা হয়েছে ১৮ বৎসর। তাহলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ -এর ৯(১) ধারা অনুযায়ী শুধুমাত্র যৌণ সঙ্গমের জন্য অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীকে সম্মতি প্রদানের বিশেষ অধিকার প্রদান করে কি-না?
আবার আমাদের দ-বিধি আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, যদি কোন পুরুষ নিম্নোক্ত পাঁচটি অবস্থার যে কোনটিতে কোন নারীর সাথে যৌন সঙ্গম করে তাহলে সে ধর্ষণ সংঘটন করেছে বলে গণ্য হবেঃ- ১) নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে; ২) নারীর সম্মতি ছাড়া; ৩) মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে সম্মতি নিয়ে; ৪) নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে; ৫) নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়। ব্যতিক্রমঃ-১৩ বছরের কম নয় এমন স্ত্রীর সাথে স্বামী যৌন সঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না। তাহলে উক্ত বিবেচনায় বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্ষণ সংজ্ঞায়িত করতে কোন বয়সটি বিবেচিত হবে? ১৩ বছর, না-কি ১৬ বছর। কারণ দন্ডবিধি ১৮৬০ অনুযায়ী, যৌন সঙ্গমের বিশেষ বিবেচনায় ১৩ বছর বয়সের নারীর বিবাহকে আইন সিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের প্রথম পর্বের ১ম অনুচ্ছেদে ১৮ বছরের নিচে সব মানব সন্তানকে শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। আমাদের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। আবার ২৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারে। এদিকে ১৮ বছর বয়সী যে কোন নারী পুরুষ সাবালক-সাবলিকা হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম উঠছে এবং তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন, নিজের মতামত প্রকাশ করছেন। অথচ জীবন সঙ্গী নির্বাচনে পুরুষের বয়স হতে হচ্ছে ২১ বৎসর।
আবার ইসলামী শরিয়ত শিশুর বয়স-সীমা সম্পর্কে সংখ্যাতাত্ত্বিক কোন সীমা না দিলেও আল-কোরআন এ শৈশব শেষ করে সাবালেগ হওয়ার কিছু নিদর্শণ বর্ণনা করা হয়েছে। ‘ শিশুরা যখন স্বপ্নে বীর্যপাত করে তখন তাদের শৈশব অতিক্রম করে সাবালকের সীমায় পৌছে যায়।’ (সুরাঃ ২৪ নূরঃ আয়াত নং ৫৯ অনুবাদঃ আল-কুর-অনুল করীম (ইফা) পৃ. ৫৭১)। মেয়েদের ঋতুস্রাবকে সাবালেগ হওয়ার চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। পনের বছর পূর্ন হওয়ার পর শরীরে বয়ঃপ্রাপ্তির লক্ষণ না পেলেও বালক এবং বালিকা উভয়কেই শরীয়তের দৃষ্টিতে বালেগ-বালেগা গন্য করতে হবে। (তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন, অনুবাদ মাওলানা মহিউদ্দিন খান, দ্বিতীয় খন্ড, ইফা. প্রকাশকাল জুন. ১৯৯৪, পৃ. ২৮৭)।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮