এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসে কোনো ভিআইপি (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হলে তাদের চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের বরাত দিয়ে জানিয়েছে আইসিইউ সুবিধা আছে এমন হাসপাতালে ভিআইপিদের চিকিৎসা করানো হবে।
সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সব সময় জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। এ কর্তব্যের অংশ হিসেবেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অর্পিত দায়িত্ব সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করতে হয়। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কানো আইন বা বিধিগত সুযোগ নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য করোনা চিকিৎসায় পৃথক ব্যবস্থা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান অনুযায়ী কতটা যুক্তিযুক্ত? সহজ উত্তর হচ্ছে, ভিআইপিদের করোনা চিকিৎসার জন্য বিশেষ সুবিধাসহ আলাদা হাসপাতাল রীতিরকম সংবিধান লংঘনের সামিল।
১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধান বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন। আমাদের সংবিধানকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক সংবিধান বলে আখ্যায়িত করা হয়। নিঃসন্দেহে এটি একজন বাঙালি হিসেবে গর্ব করার মতো বিষয়। আমাদের সংবিধানের ছত্রে ছত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব, সুপ্রিমেসি এবং অধিকার উচ্চকিত হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও এ দেশে জনগণের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বরং পাবলিক সার্ভেন্টদের সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিছু মানুষের প্রভুত্ববাদী মানসিকতায় সংবিধানের মূল চেতনা অব্যাহতভাবে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে।
প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণ প্রদত্ত ট্যাক্সের টাকায় রাষ্ট্র চলে। আমরা যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বেতন, ভাতা, যানবাহন, আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত হই, তা জনগণের প্রদত্ত করের টাকায়। যে টাকা বেতন-ভাতা পাই, সেই টাকায় পতিতার সাবান কেনার সময় প্রদত্ত ভ্যাটের টাকাও মিশ্রিত আছে। সুইপার, রিকশাচালক, দিনমজুর, কাজের বুয়াসহ সবার প্রদত্ত ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকায় প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকারি ভাতা-সহায়তা প্রাপ্তরা বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি পান। সংবিধান, আইন, নৈতিকতা কোনো দিক দিয়েই কোনো জনপ্রতিনিধি বা সরকারি কর্মকর্তা লাট বাহাদুর নন। বেতন নেব জনগণের টাকায়, শপথ নেব সংবিধান সমুন্নত রাখার, অঙ্গীকার করব প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার; কিন্তু জনগণ স্যার না ডাকলে রুষ্ট হব, জনগণকে অবহেলা করব এটি হতে পারে না। এই অবস্থান স্ববিরোধী। কারণ সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ ১৯ (১) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবে।’ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ ২৮ (১) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’
অথচ আমাদের সিস্টেম প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে পাবলিক সার্ভেন্টের পরিবর্তে ‘লর্ড অব পাবলিক’ বানিয়েছে। যোগদানের আগ মুহূর্তে তিনি দেশ, সংবিধান ও জনস্বার্থের প্রতি চির-আনুগত্যের অঙ্গীকারনামা স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু সিস্টেম তাঁকে জনসেবকের পরিবর্তে জনশাসকে পরিণত করেছে। এই মানসিকতা শুধু পাবলিক সার্ভিসে নয়, এই রোগ সর্বব্যাপী। আমরা যেকোনো সবল ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর প্রভুত্ব করা বা অযথা হয়রানি, অবজ্ঞা, অবহেলা করার মানসিক রোগাক্রান্ত। নিজের থেকে উঁচু স্তরে আপ্রান তৈলমর্দন এবং নিম্নে অবস্থানকারীদের প্রতি উল্টা আচরণ বাঙালির অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। রক্তের উপাদানগুলোর সঙ্গে মিশে আছে যুগ-যুগান্তরব্যাপী।
পাঠক নিশ্চয়ই যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে ফেরি ছাড়ায় স্কুলছাত্র তিতাসের মৃত্যুর ঘটনার কথা মনে আছে। এ বিষয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা রিটের শুনানিতে ৩১ জুলাই, ২০১৯ তারিখে ভিআইপি প্রটোকল বিষয়ে হাইকোর্ট বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ভিআইপি নয়, বাকিরা সবাই প্রজাতন্ত্রের চাকর।
রাষ্ট্রপতি থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য পর্যন্ত প্রত্যেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, বিচারপতি ও সাংবিধানিক পদমর্যাদায় নিযুক্ত সবাইকে শপথ গ্রহণ করতে হয়। সিভিল সার্ভিসে যোগদানের আগ মুহূর্তে সবাইকে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে তা দাখিল করতে হয়। সামরিক বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অঙ্গীকারনামার বাইরেও পাসিং আউট প্যারেডে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সামনে নিয়ে শপথ করেন।
ভিআইপিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হলে সরকারের অর্জন ও সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। সাধারণকে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে করোনার ছোবল। প্রজাতন্ত্রের সুবিধাজনক পদে বসে জনগণের ওপর সুপ্রিমেসি করার প্রাাগৈতিহাসিক প্রভুত্ববাদী মানসিকতার অবসান হোক। প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারী সরকারের কার্যবিধিমালা ও আচরণবিধি অনুসরণ করবে এবং সরকারও আচরণবিধির যথাযথ প্রয়োগ করবে, এটাই হোক জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com