শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
শিক্ষকরা ছাত্রদের প্রিয় হবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি যা শেখান তার সবই ছাত্র’র জীবন গঠনের জন্য। এ কারণে প্রতিটি ছাত্রই বড় হতে হতে তার শিক্ষককে প্রিয়জনরূপে ভাবতে শেখে। একেকজন ছাত্র যতটা বড় হয়, ততই সে বুঝতে পারে শিক্ষক তার কতো বড় বন্ধু। তবে বিশেষ কোন আচরণ, ঘটনা বা ব্যাক্তি স্বভাবের কারণে কোনো কোনো শিক্ষক ছাত্রদের মনে বিশেষ কোনো দাগ কেটে থাকেন। যা শিক্ষকটিকে সময়ে-অসময়ে ওই ছাত্রের মনে পড়িয়ে দেয়। তেমনি আমার জীবনের একজন আদর্শবান শিক্ষক সুলতান স্যার। বছর খানেক আগে কুষ্টিয়া জজ কোর্ট চত্ত্বরে স্যারের সাথে দেখা। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও এখনও মনোবল রয়েছে দৃঢ়। ক্লাস সেভেনে ‘ইডিয়মস এন্ড ফেরেজ’ পড়ানোর কথা স্যারকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। একগাল হেসে দিলেন। স্যারের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা আর বেত্রাঘাতের ভয়ে এতো ফ্রেজ মুখস্ত করেছিলাম যে, তৎকালীন বাজারে প্রচলিত হাইস্কুল পর্যায়ের সকল গ্রামার বইয়ে সন্নিবেশিত ফ্রেজ আজও আমার মনে আছে। আমি বাংলাদেশের শীর্ষ একটি ইংরেজি দৈনিকে সম্মানী তালিকাভূক্ত কলাম লেখক হিসেবে কাজ করি। কষ্টের সাথে জানাতে হয় যে, গত পাঁচ বছর এ পত্রিকাটি আমার কোনো লেখা এডিট করে না। আমি যা লিখি, তা হুবুহু ছেপে দেন। মনে হয় স্যারের শেখানো ইংরেজি নির্ভূল লিখতে পেরেছি।
আসলে শৈশবে একজন ছাত্রের জীবনে যে শিক্ষকরা আসেন, তারা ছাত্রদের মনে বেশি স্মরণযোগ্য হয়ে থাকেন। কারণ মানুষ হওয়ার প্রকৃত পাঠ তো তখন থেকেই শুরু। শৈশবে যতো শিক্ষক পেয়েছি অনেকের নামই এখন আর হুট করে মনে পড়ে না। অথচ কতো শতো টুকরো স্মৃতিতে জড়িয়ে আছেন তারা। প্রাথমিক, মাধ্যমিকেই দুষ্টুমির সময়। কলেজ জীবনে তেমন দুষ্টুমি করিনি। সিলেবাসের বাইরের লেখাজোখা অর্থাৎ সাহিত্য চর্চায় আর সাংবাদিকতায় ওই সময়েই আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। এ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও প্রিয় হয়ে ওঠে ডাকঘর। ডাকে সপ্তাহজুড়েই আদানপ্রদান থাকতো। পাঠাতাম লেখা, পেতাম লিটল ম্যাগ সাহিত্য পত্রিকা। এজন্যও পরিবার থেকে স্যারদের কাছে নালিশ যেতো। আমি নাকি লেখাপড়া ছেড়ে এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এ কারণে চলতো স্যারদের কড়াকড়ি। কোনো কোনো স্যার হয়ে উঠতেন অসহ্য। আজ বুঝতে পারি, এসব স্যাররা জীবনের জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। জীবনে যেটুকু আজ অর্জন তা তাদের ওই টুকরো টুকরো শাসনের জন্যই। আবার জীবনে যেটুকু বঞ্চিত হয়েছি, তা তাদেরকে ফাঁকি দিয়েছি বলেই। এজন্যই হয়তোবা প্রচলিত আছে যে, শিক্ষকদের ফাঁকি দেওয়া মানে নিজের জীবনকেই ফাঁকি দেওয়া।
মনে পড়ে পাঠ্য বইয়ে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ এর ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামে একটি কবিতা ছিল। যার প্রথম কয়েকটি চরণ : বাদশাহ আলমগীর/কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।/একদা প্রভাতে গিয়া দেখেন বাদশাহ/শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া/ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে/পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,/ শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি/ধুয়ে মুছে সব করিতেছেন সাফ সঞ্চারি আঙ্গুলি।’ পুরো কবিতাটিই গল্পের মতো। এরপরের ঘটনাক্রম এ রকম- বাদশাহ শিক্ষককে ডাকালেন। শিক্ষক ভাবলেন বাদশাহ হয়তো ছেলেকে দিয়ে পানি ঢালায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তারপরও সাহস সঞ্চয় করে বাদশাহর মুখোমুখি হলেন। কিন্তু বাদশাহর উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। বাদশাহ বললেন, আমার ছেলেতো কিছুই শিখেনি, শিখেছে শুধু বেয়াদবি। সে কেবল পানি ঢালল, কেন নিজ হাতে আপনার পা ধুয়ে দিল না। বাদশাহর বক্তব্যে সেদিন শিক্ষক আরো উচ্ছ্বসিত হলেন। কবিতাটি শৈশবে আমার মনে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। তাই শিক্ষকদের সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতাম। মেনে চলতাম। স্যার আপনার জন্য শুভ কামনা। শতায়ু হোন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮