বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৮ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
করোনার এ মহাসংকটে প্রতিনিয়ত চিকিৎসা অবহেলায় রুগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে জনবল সংকট ও নানা অজুহাত উপস্থাপিত হচ্ছে। অপচিকিৎসা দেশে দেশে একটি মানবিক অপরাধ। বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইনে ষ্পষ্ট বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি অবহেলা বা যথেচ্ছ ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে অপর কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, তবে সে ব্যক্তি দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারার অপরাধ করেছেন মর্মে গণ্য হবেন।
যখন কোনো রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং চিকিৎসক ওই রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু সংঘটিত হলে চিকিৎসক ৩০৪(ক) ধারার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। কারণ চিকিৎসকও আইনের উর্ধ্বে নন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, চিকিৎসাসেবা রাষ্ট্রের নাগরিকের অন্যতম মৌলিক চাহিদা হলেও চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে চরম অরাজকতা অবস্থা বিরাজ করছে। চিকিৎসাসেবায় বিভিন্ন অপরাধের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আইনে থাকলেও অধিকাংশ জনগনই তা জানে না। এজন্য সুষ্পষ্ট আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। ফলে চিকিৎসায় অবহেলা-সংক্রান্ত অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি পীড়িতাবস্থায় তাঁর আশ্রয়ের সর্বশেষ স্থল হিসেবে একজন চিকিৎসকের কাছে যান এই আশায় যে তাঁর চিকিৎসক প্রাণনাশী রোগের আক্রমণের বিরুদ্ধে সম্ভব সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাঁকে সারিয়ে তুলবেন এবং বাঁচিয়ে রাখবেন। রোগী চিকিৎসকের ওপরে চূড়ান্ত আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন, যা সর্বতোভাবেই নির্ভেজাল। একজন চিকিৎসককে রোগীর এই আস্থাকে গভীর মমত্ববোধের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে এবং সেই মোতাবেক চিকিৎসা সেবাদানে ব্রতী হতে হবে। রোগীর জীবন রক্ষার ও সেবাদানে চিকিৎসকের পবিত্র দায়িত্ব এবং এ দায়িত্বের পবিত্রতা রক্ষার দায়দায়িত্ব কেবল চিকিৎসককেই পালন করতে হবে কর্তব্যপরায়ণতার মাধ্যমে, অবহেলার মাধ্যমে নয়।
পাঠক নিশ্চয়ই পপসম্রাট মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কনরাড মারির করুণ পরিস্থিতির কথা মনে আছে। সংবাদটি সেসময় গোটা যুক্তরাষ্ট্রে তথা সারা পৃথিবীতে আলোচনার ঝড় উঠেছিল। ছয় সপ্তাহ শুনানি চলার পর যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসের আদালত ৭ নভেম্বর ২০১১ সালে রায় প্রদান করেন। বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই রায়ের পর ডা. কনরাড মারিকে (৫৮) যখন হাতকড়া পড়িয়ে আদালত থেকে কারাগারে নেয়া হয়। এই দৃশ্য দেখে বাইরে অপেক্ষমাণ জ্যাকসনভক্তরা তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ আবেগে কেঁদেও ফেলেন।
ভারতে ডাক্তারের অবহেলার ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে প্রচুর মামলা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কোর্ট উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির উপকারও করেছেন। তবে ভারতে ডাক্তারের অবহেলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আরেকটি বিকল্প ও কার্যকরী আইন তৈরি হয়েছে।
১৯৮৬ সালের কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট নামে এ আইনের আওতায় ডাক্তারের অবহেলার ফলে কোনো রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলে কনজিউমার কোর্টে গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারে। এ কোর্টে কোনো কোর্ট ফি লাগে না। এবং খুব দ্রত বিচার করে থাকে। ফলে দরিদ্র রোগীরাও এখানে বিচারের জন্য আসতে পারে। আমাদের দেশে এ রকম কোনো আইন নেই। বর্তমান আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে এ ধরনের একটি আইনের প্রয়োজন উপেক্ষা করা যায় না। তবে আপাতত জনস্বার্থে মামলার মাধ্যমে সরাসরি হাইকোর্টে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর সমাধানের চেষ্টা করা যায়। একই সঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতে যেটুকু আইনগত সুবিধা রয়েছে তার সর্বোচ্চ সুযোগ নেয়া উচিত। আইনের অপূর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও আমরা যতোটুকু পারি তার সদ্ব্যবহার করতে পারি।
বালাদেশে চিকিৎসা-সংক্রান্ত মামলা তেমন একটা হয় না বললেই চলে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সুষ্পষ্ট আইনের অভাব। এরপরও অপ্রতুল আইনি ব্যবস্থায় যা আছে, তাতে ডাক্তারি অবহেলা একই সঙ্গে দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যায়। টর্ট আইনে অবহেলা বলতে বোঝানো হয়েছে, কারও প্রতি যত্ন নেওয়ার আইনগত দায়িত্ব পালনে অপরের ব্যর্থতা। টর্ট আইনে বা দেওয়ানি মামলায় ডাক্তারি অবহেলার বিরুদ্ধে হয়রানি, মানহানি, মিথ্যা প্রলোভন সহ ক্ষতিপূরণের মামলা করা যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে বেশ জটিলতা দেখা যায় এবং এর পরিচালনায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, যা দরিদ্র লোকের পক্ষে জোগাড় করা দুরূহ। এছাড়া সাক্ষ্য গ্রহণেও দেখা দেয় জটিলতা। এ ধরণের মামলায় মূলত ডাক্তার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষী করতে হয়। ফলে ঘটনার ব্যাপারে সত্যতা উদঘাটন অসম্ভব হয়ে যায় এবং প্রতিকার সম্ভব হয় না।
চিকিৎসায় অবহেলায় ফৌজদারী মামলা করা যায়। এ অপরাধের ক্ষেত্রে হটকারিতা, অসতর্কতা, অবহেলা বা বেপরোয়া কাজ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। রশিদুল্লাহ বনাম রাষ্ট্র (২১) ডিএলআর (৭০৯) মামলায় বলা হয়েছে, বেপরোয়া বা হটকারি কাজ মানে হচ্ছে কোনো বিপজ্জনক কাজের ঝুঁকি নেওয়া এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজটি সম্পাদন করা। ডাক্তারি অবহেলাও দণ্ডবিধির এ ধারায় অন্তর্ভূক্ত হবে।
এছাড়া ৩১৪ ধারায় গর্ভপাত-সংক্রান্ত অপরাধ এবং ৩২৩ থেকে ৩২৬ ধারায় অন্তভূর্ক্ত অবহেলা সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের শাস্তির আওতায় ডাক্তারি অবহেলা সংক্রান্ত অপরাধের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া দণ্ডবিধির ৩৩৬ ধারা অনুযায়ী, বেপরোয়া কাজ বা অবহেলার কারণে প্রাণনাশ বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সর্বোচ্চ ৩ মাসের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা জরিমানার কথা উল্লেখ আছে। দণ্ডবিধির ৩৩৭ ধারাতেও অবহেলাজনিত কারণে আঘাত দিলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত শাস্তির বিধান আছে। তবে ৩৩৮ ধারাটি ডাক্তারি অবহেলা-সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিকারের ক্ষেত্রে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ধারায় উল্লেখ আছে, যে কোনো ধরণের বেপরোয়া কাজ বা অবহেলার কারণে আঘাত দিলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা দুটি একসঙ্গে দেওয়া যাবে।
এছাড়া বাংলাদেশে দ্য মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস্ অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিষ্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ নামে একটি আইন আছে। যাতে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে এবং প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপন ও পরিচালনায় সুষ্পষ্ট নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী কোনো সরকারী চাকুরিতে নিযুক্ত আছেন, এমন কোনো রেজিষ্টার্ড চিকিৎসক অফিস চলাকালীন কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা নার্সিং হোমে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন না এবং করলে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু দেশের যত্রতত্র ক্লিনিক গড়ে উঠেছে এবং এর জন্য যথাযথ লাইসেন্স গ্রহণ করা হচ্ছে না। এসব ক্লিনিকে সংঘটিত অপরাধেরও বিচার হচ্ছে না। অপারেশনের ফিসসহ বিভিন্ন কারণে ভর্তি হওয়া রোগীদের কাছ থেকে কী পরিমাণ ফি নির্ধারণ করা হবে, তা এ আইনে উল্লেখ আছে, যা সচরাচর মানা হয় না। যেমন আইনে সিজারিয়ান অপারেশনের ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা থাকলেও বাস্তবে বহুগুণ বেশী আদায় করা হচ্ছে। এ আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, এ অধ্যাদেশের বিধান লংঘন করা হলে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা। আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও এর কোনো প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
মূলত চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবহেলা-সংক্রান্ত অপরাধ বলতে ডাক্তারী অবহেলাকেই বোঝানো হয়। ডাক্তারি অবহেলা বলতে শুধু ডাক্তারদের অবহেলা নয়, এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা, নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টেকনিশিয়ান, ওষুধ সরবরাহ ও সরবরাহকারীদের অবহেলা প্রভৃতিও বোঝানো হয়। ডাক্তারদের যে সব আচরণ অবহেলা হিসেবে গণ্য হয়, সেগুলোর মধ্যে রোগীকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা, ভুল ঔষধ বা ইনজেকশন প্রয়োগ, ভুল অপারেশ করা, অস্ত্রপাচারের উপকরণ রোগীর শরীরের ভেতর রেখে দেওয়া প্রভৃতি। এ ছাড়া রোগীর সঙ্গে দূর্ব্যবহার, ফি নিয়ে দরকষাকষিও চিকিৎসকদের অবহেলার মধ্যে পড়ে। অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সরকারী হাসপাতালে কর্তব্য পালন অবস্থায় প্রাইভেট ক্লিনিকে কর্মরত থকেন, যা একটি অপরাধ। আবার অনেকেই নিজেদের উপার্জিত ডিগ্রির পাশে অনেক ভূয়া বিদেশী ডিগ্রি জুড়ে দেন, যা অন্যায় ও প্রতারণার শামিল। ডাক্তারি রিপোর্ট বা পোস্টমর্টেম রির্পোটে ভুল উপায় সংযোজন করা, মনগড়া রিপোর্ট ও জালিয়াতি করা একটি অপরাধ। এ ছাড়া রোগীর মূল দলিল দিতে অবাধ্যতা, বারবার রোগীকে হেনস্থা করা, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সিট না বরাদ্দ দিয়ে অন্যত্র ব্যবস্থা করা প্রভৃতিও অবহেলা-সংক্রান্ত অপরাধের শামিল। অপারেশনে নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত ফি দাবি করাও একটি অন্যায়মূলক কাজ।
আমাদের দেশে রোগীরা প্রতিনিয়তই চিকিৎসক দ্বারা আর্থিকভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। কোনো রোগী তার রোগ নিরাময়ে বা কষ্ট লাঘবের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে প্রথমেই তাকে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত অর্থ ফি প্রদান করতে হয়। বাংলাদেশে মানুষের যে আয় তাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ আয়ের পরিমান বিবেচনা করলেও জনপ্রতি রোগী থেকে ১০০ টাকার বেশি নেয়া অযৌক্তিক। চিকিৎসক তো মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নন। অতিরিক্ত আয় যাদের জীবনের লক্ষ্য তাদের চিকিৎসা সেবা পেশায় না আসাই উচিত।
রোগীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই চিকিৎসক অনেক টেস্ট করাতে পরামর্শ প্রদান করেন। যদি ১০ প্রকার টেস্ট করানো হয়ে থাকে, তাহলে বেশির ভাগ টেস্টের ফলাফল থাকে নরমাল (স্বাভাবিক)। অর্থাৎ টেস্টে রোগীর কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। এতে সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, চিকিৎসকরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত টেস্ট করাতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে কেন তারা রোগীদের অতিরিক্ত টেস্ট করাতে পরামর্শ প্রদান করেন? জবাব খুব সহজ, যখন কোনো রোগী চিকিৎসকের পরামর্শপত্র নিয়ে টেস্ট করানোর উদ্দেশে কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উপস্থিত হন তখন রোগীর কাছ থেকে টেস্টের ন্যায্য চার্জের দ্বিগুণ আদায় করা হয় এবং পরামর্শ প্রদানকারী চিকিৎসকের নাম-ঠিকানা নোট করে রাখা হয়। পরে রোগীর কাছ থেকে আদায়কৃত চার্জের ৪০-৫০ শতাংশ গোপনে চিকিৎসককে দিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকও নির্দ্বিধায় সে অর্থ গ্রহণ করেন। এটা কি রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের প্রতারণা বা দুর্নীতি নয়? সরকার চিকিৎসকদের পরামর্শ দিলে বা সতর্ক করলে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। সরকার কয়েক বছর আগে বিভিন্ন টেস্টের সর্বোচ্চ চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। সে হারে পুনর্বিবেচনা করে বর্তমানে প্রচলিত চার্জ অর্ধেক হ্রাস করা প্রয়োজন। এতে করে টেস্ট করার পর চিকিৎসকদের প্রদান করার মতো অতিরিক্ত অর্থ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর কাছে থাকবে না। বাংলাদেশের মানুষের আয়-ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করে দেয়া এবং টেস্টের বর্তমান চার্জ অর্ধেক হ্রাস করার সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সরকারের স্বাস্থ্য খাতে মোটা অঙ্কের বাজেট পাস হয়। ডাক্তারদের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে, সব কিছুই ঠিকঠাক কিন্তু ঠিক নেই চিকিৎসাসেবা। ডাক্তারদের সরকারি অফিসে চলে তাদের শুধু হাজিরা, বাদবাকি প্রাইভেট প্রাকটিস, কে কত টাকা কামাতে পারে সে প্রতিযোগিতা চলছে বাণিজ্যিকভাবে। এর একমাত্র কারণ কোথাও জবাবদিহিতা নেই। কাউকে কোথাও বদলি করলে রাজনৈতিক তদবির তো আছেই। ঘুরেফিরে বহাল তবিয়তেই থাকেন তারা। এত আরাম, অর্থ, বিত্ত, প্রভাব ডাক্তারদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। সঙ্গত কারণে অধঃস্তনরাও সুযোগ নেয়। তাদের অবহেলার কারণে দেশের বিশাল অঙ্কের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিকিৎসায় কারিগরি মান অনেক উন্নত হলেও ডাক্তাররা পিছিয়ে আছেন। সেটি কি তারা বুঝতে পারছেন? তাদের অবহেলার কারণে দেশের বিশাল অঙ্কের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশে অত্যাধুনিক মাল্টিস্টোরিড প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ল্যাব, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, স্যাটেলাইট ক্লিনিক, এনজিও স্বাস্থ্যসেবা, যা প্রত্যন্ত গ্রামজুরে জালের মতো বিস্তৃত রয়েছে। তারপরও মানুষ চিকিৎসাসেবার জন্য হাসপাতালে না গিয়ে অন্ধের মতো দৌড়ায় ওঝা, বৌদ্ধ, কবিরাজ, ফকির, দরবেশ, ব্রাহ্মণের কাছে। এ সংখ্যাটি কিন্তু কম নয়। তারা কেন হাসপাতাল ডাক্তারবিমুখ তা কি জানেন? কারণ হাসপাতালে চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, প্রতারণা, ভুল চিকিৎসা, অবহেলা ইত্যাদি চলে, তাই তারা ওখানে যেতে ভয় পায়। রোগে ভুগতে ভুগতে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আসে তখন কিছুই করার থাকে না। তুক-তাক, ফুঁক-ফাঁক, তাবিজ-কবজ নিতে গিয়ে তারা খুব রকম প্রতারিত হয় তবুও হাসাপাতলমুখী হতে চায় না।
গ্রামের দরিদ্র প্রসূতি মায়েরা অনভিজ্ঞ দাইয়ের কাছে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও হাসপাতালের বারান্দায় বসে প্রসব বেদনায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর চেয়ে উত্তম মনে করে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষটি ৫ টাকায় টিকেট কিনে বিশাল লাইনে দাঁড়ায় হাসপাতালের বারান্দায়, ফ্লোরে চিৎকাত হয়ে শুয়ে-বসে দিন-রাত কাটায় শুধু একটু চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসা হলেই হয় না, সে মতো ওষুধ কিনতে হয়, হাসপাতাল থেকে শুধু প্যারাসিটামল ও এন্টাসিড ফ্রি’তে আরোগ্য হয় না।
তার বাকি ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই, দশ জায়গায় ঘুরে বেড়ায় সাহায্যের জন্য। পেটে ব্যথা উঠলে খাবার সোডা খেয়ে ব্যথা প্রশমিত করে। আস্তে আস্তে একদিন নাড়িভুঁড়ি ক্ষয় হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, এই হলো তাদের জীবন। অথচ তাদের জন্য বরাদ্দ ওষুধ, খাবার, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বরাদ্দ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করে কেউ কেউ অট্টালিকা তৈরি করে, টাইলস লাগায়, এসি লাগায়, রঙ-ঢঙ বদলায়।
থানা পুলিশ ভাল, না মেডিকেল হাসপাতাল ভাল (সেবার মানের বিবেচনায়)। থানা পুলিশ তাদের সেবা দ্বারা একজন সুস্থ মানুষকে অসুস্থ মানুষে পরিণত করে। অন্যদিকে মেডিকেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহেলায় একজন মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যেতে হয়। সেদিক থেকে থানা পুলিশ ভাল। সচেতন মানুষের পক্ষে সরকারের কাছে আমার প্রশ্ন, মানুষের জীবন নিয়ে এই খেলা আর কতদিন চলবে।
সবিশেষ চিকিৎসকদের সমীপে নিবেদন, দেশে চিকিৎসাসেবার নামে যা চলছে তা কি চলতে দেয়া যায়? আপনারা উচ্চশিক্ষিত মেধাবী সন্তান, নৈতিকতার স্খলনে গা না ভাসিয়ে গণমানুষের সেবা করুন, এ ক্রান্তিলগ্নে দেশকে এগিয়ে নিন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮