বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৮ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক :
দেনমোহর বিবাহিত মুসলিম নারীর একটি বিশেষ অধিকার। এই অধিকার মুসলিম আইনের উৎস পবিত্র কোরআন দ্বারা স্বীকৃত। দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য এবং স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়। এটি স্বামীর উপর আইন কর্তৃক আরোপিত একটি দায়। বিবাহের অন্যতম শর্ত দেন-মোহর। এই শর্তটি পূরণ ব্যতীত কোন বিবাহ বৈধ হতে পারে না।
সুতরাং বিয়ের আসরে বা অনুষ্ঠানে স্বামী তার স্ত্রীকে মর্যাদাস্বরুপ যে অর্থ বা সম্পদ দেয় বা দেবার অঙ্গীকার করে তাকে দেনমোহর বলে। দেনমোহর স্ত্রীর একচ্ছত্র অধিকার এবং এটা স্বামীর কাছে স্ত্রীর প্রাপ্য। বিয়েতে যদি দেনমোহর নির্ধারণ করা না হয়, তবে স্ত্রী তার মর্যাদা ও যোগ্যতার বিচারে দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। এমন কোনো প্রতিষ্ঠিত নীতি বা যুক্তি কিংবা আইন নেই, স্ত্রী তার স্বামীর নিকট নিজেকে সমর্পণ করলে বা মৌখিকভাবে স্বামী কর্তৃক মাফ চাওয়ার পর মাফ শব্দটি উচ্চারণ করলে আশু দেনমোহরের দাবি নিঃশেষ হয়ে যায়।
মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ (২১ ডি.এল.আর) মামলায় মহামান্য বিচারপতি কর্তৃক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, ‘সহবাসের আগে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর কাছে তলবী মোহরানার দাবি করতে পারে এবং স্বামী তলবী দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্ত্রী তার স্বামীর অধিকারে অর্থাৎ সহবাসে যেতে স্ত্রী অস্বীকার করতে পারেন।’ এ অজুহাতে স্বামী স্ত্রী থেকে দূরে অবস্থান করলে তা পরিশোধে বাধ্য। (১১ ডি এল আর (ডবলু পি) লাহোর ১২৪। স্বামী এহেন মোহরানা পরিশোধ ব্যতীত দাম্পত্য অধিকারের ডিক্রি পেতে পারে না। যে কোন বিষয় সম্পত্তি মোহরানার জন্য ধার্য করা যায় না। ইহা হতে পারে নগদ অর্থ, কোন বীমা পলিসি বা অন্য কোন দ্রব্য সামগ্রী। তবে কোন হারাম বস্তু হতে পারবে না। স্বামীর দখলে নেই এমন কোন সম্পত্তি পারে না। ভবিষ্যত কোন বিষয়ও এর অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে না।
দেনমোহর নির্ধারণ পদ্ধতি
মোহরানার পরিমান সুনির্দিষ্টভাবে বেঁধে দেয়া হয়নি। তাই তা আপেক্ষিক। অর্থাৎ বর ও কনের উভয়ের দিক বিবেচনান্তে তা নির্ধারিত হয়। দেনমোহর কত হবে তা নির্ণয়কালে স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে যেমন স্ত্রীর বোন, খালা, ফুফুদের ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ কত ছিল তা বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া স্ত্রীর পিতার আর্থ-সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত যোগ্যতা, বংশ মর্যাদা, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। অপর দিকে বরের আর্থিক ক্ষমতার দিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়। এসব দিক বিচার বিবেচনা করেই মূলতঃ দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। উল্লেখ্য, দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না, তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন।
হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর অন্যতম স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে ৪ হাজার দিরহাম মোহর দিয়েছিলেন। এই মোহর নাকি নির্ধারন করেছিলেন তৎকালীন আবিসিনিয়ার সম্রাট নাযাশি (আবু দাউদ, ‘কিতাব এন নিকাহ’২:২৩৫)। মোহরের সর্বোচ্চ পরিমান কত হবে, তা কখনোই নির্ধারিত করা হয়নি। স্বামীর অর্থনৈতিক যোগ্যতা, অবস্থা ভেদে এটি নির্ধারিত হতো। এ বিষয়ে একটি দৃষ্টান্ত মূলক ঘটনার নজীর রয়েছে। দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাতাব (উল্লেখ্য খলিফা ওমরকে ইসলামের সকল মাহজাবের অনুসারীরা একরকমভাবে গ্রহন করেন না) তার ভক্ত সমাবেশে ঘোষণা দেন, নসিহত করেন যে,‘ কেউ খুব ভারী ও বিপুল রকমের মোহর নির্ধারন করবেন না। কারন নবীজী মুহাম্মদ চার’শ দিরহামের বেশি পরিমান মোহর কাউকে দিতে বারন করেছেন।’ তৎক্ষণাৎ এ কথার প্রতিবাদ জানান ওই সমাবেশে আগত এক নারী। তিনি কোরানের ৪:২০ সুরা ও আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরে বলেন,“ তুমি যদি একজনের পরিবর্তে অন্য একজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করো এবং যদি প্রথম স্ত্রীকে মোহরানা হিসাবে কয়েক রাশি স্বর্নমুদ্রাও দাও, তাহলে তার এক তিল পরিমানও তুমি সাবেক স্ত্রীর কাছ থেকে ফেরত নিতে পারবে না। খলিফা ওমর সঙ্গে সঙ্গে নিজের কথাটি প্রত্যাহার করে ওই নারীর বক্তব্যটিকে সঠিক বলে মন্তব্য করেন ‘যিনি যে পরিমান মোহর দিতে চান তিনি সে পরিমানই দিতে পারবেন’ (ইবনে হযর আল-আথকালানি, ফাত আল-বারী, ৯:১৬৭”)।
বিয়ের সময় দেনমোহর নির্ধারণ না হলে
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ১০ ধারা মোতাবেক দেনমোহর প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে কাবিনে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলেও স্ত্রী চাহিবামাত্র সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। বিয়ের সময় যদি দেনমোহর নির্ধারণ করা না হয় এমনকি স্ত্রী পরবর্তীতে কোন দেনমোহর দাবী করবে না এ শর্তে বিয়ে হয় তাহলেও স্ত্রীকে উপযুক্ত দেনমোহর দিতে হবে। দেনমোহর বিয়ের পূর্বে, বিয়ের সময় এমনকি বিয়ের পরে নির্ধারণ করা যেতে পারে। (কামরুননেসা বনাম হুসাইন বিবি, ১৮৮০, ৩ অল. পৃষ্ঠা-২৬৬)। বিয়ের পর দেনমোহর বৃদ্ধি করা যেতে পারে। (জহুরান বিবি বনাম সোলেমান খান, ১৯৩৩, ৫৮ ক্যাল. এল. জে. পৃষ্ঠা-২৫১)।
দেনমোহরের প্রকারভেদ
দেনমোহরের মূলতঃ দুই প্রকারের, যথা:
(ক) নির্ধারিত দেনমোহর
যেক্ষেত্রে বিবাহের চুক্তিতে বা বিবাহের পূর্বে কিংবা পরে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সেটা নির্ধারিত দেনমোহর। এইরূপ দেনমোহরের জন্য কোন সর্বোচ্চ পরিমাণ অর্থ নির্ধারিত নাই। দেনমোহর হিসাবে যে কোন পরিমাণ অর্থ নির্ধারিত হতে পারে, যদিও তাহা স্বামী কর্তৃক পরিশোধের ক্ষমতার বাহিরে, কিন্তু কোন অবস্থায়ই আইনে নির্ধারিত পরিমাণের কম হতে পারবে না। নির্ধারিত দেনমোহরের পরিমান কোন ক্রমেই দশ দিরহামের কম হবে না। (সাহাবুদ্দিন বনাম উমাতুর রসুল, ৬০, এপি, ৫১১)। স্ত্রী দেনমোহরের দাবীতে মামলা করলে, দেনমোহরের পরিমান বেশী বা স্বামীর সামর্থ্যওে উর্ধ্বে এরুপ কথা স্বামীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অজুহাত হিসেবে গ্রাহ্য হবে না। (মোহামেদ সুলতান বেগম বনাম সারাজ উদ্দিন আহম্মেদ, ১৯৩৬, ১৬১ আই.সি, ৩০০)
(খ) উপযুক্ত দেনমোহর
যেক্ষেত্রে বিবাহের চুক্তিতে বা বিবাহের পূর্বে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত হয় না সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ হিসাবে দেনমোহর পরিশোধ করার জন্য আইন দ্বারা নির্ধারণ করা হয়, তাকে উপযুক্ত দেনমোহর বলে। যখন এইরূপ কোন প্রকাশ্য শর্তে বিবাহের চুক্তি সম্পাদিত হয় যে, কোন মোহরানা পরিশোধ করা হবে না অথবা যখন কোন মোহরানার পরিমাণ ধার্য করা না হয় তখন সে বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী ন্যায্য বা উপযুক্ত পরিমাণ মোহরানা পাওয়ার অধিকারী হন। পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্য যেমন পিতার বোনদের নির্ধারিত দেনমোহর বিবেচনা করে উপযুক্ত দেনমোহর নির্ণয় করতে হবে। ( হামিরা বিবি বনাম যুবাইদা বিবি, ১৯১৬, ৪৩ আই.এ, পৃষ্ঠা-২৯৪)।
স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে কিংবা তালাক হলে
স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীর সম্পূর্ণ দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর আগেই স্ত্রী দেনমোহর দাবি করতে পারে এবং স্বামী তখন নির্ধারিত দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ তাই যে কোনো সময় স্ত্রী তা দাবি করতে পারে।
দেনমোহর চেয়ে না পেলে সেক্ষেত্রে স্ত্রীর করণীয়ঃ
যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর কাছে নির্ধারিত দেনমোহর চেয়ে না পায়, তবে সেই স্ত্রী নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে পারে। যেমন-
১। স্বামীর সাথে বসবাস করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে (মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ ২১ ডিএলআর)
২। দাম্পত্য মিলনে অনীহা প্রকাশ করতে পারে
৩। এমন কি সে দূরে বসবাস করতে পারে। (১১ ডিএলআরর, ১২৪)
এ সময় স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবে। এসময় কোন স্বামী যদি দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা করে, তবে তার মামলা খারিজ হয়ে যাবে, কারণ স্বামী, স্ত্রীর দাবি অনুযায়ী দেনমোহর পরিশোধ করেনি।
স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর দেনমোহর আদায়
স্বামীর মৃত্যুর পর দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ হিসেবে ধরা হবে। অন্যান্য ঋণের মতোই এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। দাফন-কাফনের খরচ করার পর অবশিষ্ট সম্পত্তি থেকে দেনমোহর ও অন্যান্য ঋণ পরিশোধ করতে হবে, এমন কি এই ঋণ পরিশোধ না করলে স্ত্রী স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে দেনমোহরের জন্য মামলাও করতে পারে। স্বামীর আগে স্ত্রীর মুত্যু হলেও দেনমোহর দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহর পাবার অধিকারী। তারা দেনমোহর পাবার জন্য মামলাও করতে পারে। এছাড়া স্ত্রী দেনমোহর পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তার স্বামীর অন্যান্য ওয়ারেশদের এবং তার স্বামীর পাওনাদারদের বিরুদ্ধ জনিত দখল বজায় রাখতে পারবে। তবে সেই সম্পত্তিতে মুনাফা সম্পর্কে স্বামীর অন্যান্য ওয়ারেশদের হিসেব দেয়া বিধবার দায়িত্ব। (বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ, ১৮৭১, ১৪ এম.আই.এ. পৃষ্ঠা-৩৭৭)।
স্বামী স্ত্রীকে কোনো উপহার দিলে তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে কি-না
স্বামী স্ত্রীকে কোন কিছু উপহার হিসেবে দিলে তা অবশ্যই দেনমোহর নয়। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারে। স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে কিছু দেয়, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা থাকতে হবে। যেমন: জমি হস্তান্তর দলিলে “দেনমোহর বাবদ” কথাটি লেখা না থাকলে এরূপ জমি-দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে না। (আ: কাদের বনাম সালিমা, ১৮৮৬, ৮ অল. পৃষ্ঠা-১৪৯)।
তবে মোহরানার পরিবর্তে হিবা বিল এওয়াজের রীতিও রয়েছে। ১৯৫৫ সালে ঢাকা হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, মোহরানার পরিবর্তে হিবা-বিল-এওয়াজ তখনই বৈধ হবে যখন স্ত্রী কোন প্রতিদান ছাড়াই স্বামীকে মোহরানা দান করে দেয় এবং পরে স্বামী স্ত্রীর দানের “এওয়াজ” স্বরূপ কোন সম্পত্তি আলাদাভাবে দান করে, কারন এটা মুসলিম আইনে একটি বিশুদ্ধ হিবা বিল এওয়াজ হবে। এমনকি যদি স্বামী স্ত্রীকে কোন কিছু দান করেন এবং স্ত্রী স্বামীর বরাবরে প্রতিদান স্বরূপ অন্য কোন দলিল মূল্যে মোহরানার অধিকার ছেড়ে দেয় তবে উহা আধুনিক প্রকৃতির একটি হিবা বিল এওয়াজ বলে গন্য হবে, (পিএলডি, ১৯৫৫, ঢাকা. পৃষ্ঠা ৩৯)।
হাইকোর্ট বিভাগের একটি মামলায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বিয়ের সময় স্বামী তার স্ত্রীকে দেনমোহর হিসেবে পাঁচ বিঘা জমি দিতে চায়। সে মতে স্বামী ওই জমি স্ত্রী বরাবর প্রদানও করেন। পরে স্বামী তার স্ত্রীর সাথে এ মর্মে মধ্যস্থতা করে যে, ওই পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে ভালো জায়গায় ১৩ বিঘা জমি ক্রয় করবে। সেখান থেকে স্ত্রীকে পাঁচ বিঘা জমি ফেরত দেবে। কথা দিয়ে কথা না রাখলে স্ত্রী স্বামীর কাছে দেনমোহর চেয়ে মামলা করে।
স্বামী ওই মামলায় প্রতিযোগিতা করে। স্বামী এই মর্মে অজুহাত উত্থাপন করে যে, পারিবারিক আদালতে ওই মামলা অচল। কারণ তিনি জমিটি ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং মামলাটি দেওয়ানি আদালতে বিচার্য। মামলাটিতে পারিবারিক আদালত স্ত্রীর পক্ষে ডিক্রি প্রদান করলেও স্বামী হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করে। মহামান্য হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখে ১৩ বিঘা জমির মধ্যে পাঁচ বিঘা জমি তার স্ত্রীকে প্রদানের নির্দেশ দেন। (রওশন আরা বেগম বনাম মাসক আহমেদ ২৩ বিএলডি হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা- ৩০২)।
দেনমোহরের পরিবর্তে স্ত্রীর বরাবর জমি সম্পত্তি হস্তান্তর এক শত টাকা মূল্যের অধিক হলে অবশ্যই রেজিস্ট্রি দলিল দ্বারা হস্তান্তর করতে হবে (৪ ডিএলআর, পৃষ্ঠা-৫১)।
স্বামী যদি স্ত্রীকে টাকা দেয়, একবার নয়, অনেকবার তবুও ধরিয়া লওয়া যাইবে না যে, এই টাকা তাহার দেনমোহরের জন্য দেওয়া হইয়াছে। উল্লেখ্য, স্ত্রীর ভরণপোষণ কখনও দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে না।
দেনমোহর কখনো মাফ হয় না
স্ত্রী দেনমোহর মাফ করতে পারে। যদিও স্বামী চাইল আর স্ত্রী সাথে সাথে তা মাফ করে দিলো, বিষয়টা এত সহজ নয়। সহজে দেনমোহর মাফ হয় না। দেনমোহর মাফ করার সময় স্ত্রীর পূর্ণ সম্মতি থাকতে হবে। একইসাথে তাকে স্বেচ্ছায়, কোন রকম প্ররোচণা ছাড়া মুক্তমনে দেনমোহর মাফ করতে হবে। পাকিস্তান ল ডাইজেস্ট (১৯৫৯) লাহোর এর ৭১০ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে, স্ত্রীকে মোহরানা দেয়া হয়েছে কিনা যিনি তা পরিশোধ করেছেন তাকেই তা প্রমান করতে হবে। তবে স্ত্রী দেনমোহরের অর্থ হ্রাস বা মওকুফ করতে পারে।( ফায়ানী বেগম বনাম ওমরাভ বেগম, ১৯০৮, ৩২ বম. পৃষ্ঠা-৬১২)।
দেনমোহরের অংশ
দেনমোহরের দুটো অংশ যথাক্রমে (১) মুয়াজ্জল (আশু) দেনমোহর (২) মু-অজ্জল (বিলম্বিত) দেনমোহর।
ক) মুয়াজ্জল বা আশু দেনমোহর হচ্ছে, নগদে স্ত্রীকে প্রদান করা অর্থাৎ বিয়ের আসরে দিতে হয়। বিয়ের আসরে না দিতে পারলে পারিবারিক জীবন চলাকালীন সময়ে দেনমোহরের যে অংশটুকু স্ত্রী চাহিবামাত্র স্বামী পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। যদি না দেয় তাহলে স্ত্রী স্বামীর সহবাসে যেতে অস্বীকার করতে পারে। (রাহিলান বনাম সানাউল্লাহ, ১৯৫৯, পি.লাহ. পৃষ্ঠা-৪৭০)।
খ) মু-অজ্জল বা বিলম্বিত দেনমোহর হচ্ছে, দেনমোহরের যে অংশটুকু স্বামীর মৃত্যুর পর কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের পর স্ত্রী পেয়ে থাকে। আরও পরিস্কার করে বলা যায় যে, আইন অনুযায়ী কেবলমাত্র দুইটি পরিস্থিতিতে বিলম্বিত মোহরানা স্ত্রী দাবি করতে পারেন। একটি হচ্ছে যদি স্বামীর মৃত্যু হয় অথবা তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গ যায়। অপরটি হচ্ছে, যদি স্বামী সালিসি পরিষদ অথবা স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহন করেন। দেনমোহর কেনো স্ত্রীর ভরণপোষন নয়। এটি বিয়ের পর স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত কোনো উপহারও নয়। বরং বিয়ের সময় স্বামীর কাবিননামায় প্রতিশ্রুত অর্থ। যা স্বামী কোনো ভাবেই উপেক্ষা করতে পারেন না।
“আর তোমরা নারীদেরকে তাদের দেনমোহর খুশিমনে দিয়ে দাও। যদি তারা খুশি মনে তার কিছু ছেড়ে দেয় তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ কর”.সুরা নিসা।
জামিনদার
যদি কোন ব্যক্তি একজনের স্বামীর স্ত্রীর মোহরানার দায়িত্ব নেয় তবে সে উহা পরিশোধের জন্য দায়ী হবে। বিবাহ উত্তর দেনমোহরের জন্য জামিনদার থাকলে সেক্ষেত্রেও জামিনদার দায়ী হবে। স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। যদি স্বামীর উত্তরাধিকারীরা স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
উল্লেখ্য, যদি স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা ঐ দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। ফলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা দেনমোহর পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করতে পারবেন।
দেনমোহরের মামলা ও তামাদি আইন
কস্ত্রী তার দেনমোহরের টাকা না পেলে সে এবং তার মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীগন এর জন্য মামলা দায়ের করতে পারে।
খ) আশু দেনমোহর স্ত্রী চাহিবা মাত্র স্বামী দিতে বাধ্য। স্বামী দিতে অস্বীকার করলে বা না দিলে সেদিন থেকে তিন বৎসরের মধ্যে স্ত্রীকে মামলা দায়ের করতে হবে। বিলম্বিত দেনমোহর আদায়ের সময়সীমা হল মৃত্যু অথবা তালাকের ফলে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলে ওই তারিখ হতে তিন বৎসরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। তা না হলে মামলা তামাদি হয়ে যাবে।
স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক প্রদানের পর স্ত্রী যেই আদালতের এলাকায় বসবাস করেন ওই আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। এর জন্য মাত্র পঁচিশ টাকা কোর্ট ফি দিতে হয়। দেনমোহরের দাবিতে কোনো বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি দখল করে থাকলে যদি তাকে ওই সম্পত্তি থেকে অন্যায়ভাবে বেদখল করা হয়, তবে সে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে (মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব ১৯১৬, ৪০ বম. পৃষ্ঠা-৩৪)।
মোহরানা সম্পর্কিত অতীত ইতিহাস
ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, হযরত আলী (রা.) যখন মুহাম্মদ (স.) কন্যা ফাতিমা (র.) কে বিয়ে করেন। তখন মহরানা দেয়ার মতো আলীর কোনো নগদ অর্থ সম্পদ ছিল না। বিয়ের সময় তার মালিকানায় ছিল কেবলমাত্র উট, তরবারি আর বর্ম। উট তরবারি তার জীবন যাপনের জন্য অতি আবশ্যক ও জরুরী বলে নবীজী আলীকে উট তরবারি বাদ দিয়ে বিয়েতে তার বর্ম মোহরানা হিসাবে দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। পরামর্শ যথারীতি পালন করেন আলী।
নবী মুসা (আ.) (মোজেস) যখন মিশর থেকে মদিনায় এসে সাফুরাকে বিয়ে করেন তখন তার মোহর দেওয়ার মতো কোন যোগ্যতাই ছিল না। সে কারনে সাফুরার পিতাকে তিনি কোন প্রকার মজুরি ছাড়াই দশ বছর সাফুরার বাবার গবাদি পশু চারণ ও পালন করে প্রতিদান হিসাবে তার শ্রম উপহার দেন।
ইতিহাস ও মহাগ্রন্থ বলে যে, একজন উদার ও ন্যায়পর স্ত্রী স্বামীর আর্থিক ও বাস্তব প্রতিকূলতা বুঝে ইচ্ছে করলে তার মোহরের দাবি ত্যাগও করতে পারেন। কিন্তু একবার যদি মোহর নির্ধারিত হয়ে যায় বিশেষত লিখিত আকারে, তবে সে মোহর স্বামীকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। কোন স্ত্রীকে তার স্বামী বা অন্য কেউ মোহরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কোন প্রভাব খাটাতে বা চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮