বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৫ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
তালাক একটি আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা, পরিত্যাগ করা বা বন্ধনমুক্ত করা। স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষেই বা যে কোন এক পক্ষের সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে।
একজন স্বামী যেমন তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে, অনুরুপ একজন স্ত্রীও তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে। এ অধিকারটি ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে। তবে উক্ত আইনের ধারা ২ এ কিছু শর্ত সাপেক্ষের কথা বলা হয়েছে।
তালাকের আইনগত দিক :
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর ৭ ধারার বিধান মতে,
১. কোন ব্যক্তি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর তালাক দিয়াছে বলিয়া যথাশীঘ্রই সম্ভব স্থানীয় ইউপি/পৌর/সিটি কর্পোরেশন (চেয়ারম্যান)কে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। (উল্লেখ্য, তালাকের নোটিশের নির্দিষ্ট কোন ফরমেট নেই। কাজেই সাদা কাগজে তালাকের কারণগুলো লিখে চিঠি আকারে পাঠালেও দোষের কিছু নেই)।
নোটিশ দেয়া না হলে তালাক বাতিল করেছে বলে গণ্য হবে। (৫৮ ডিএলআর ২৭১, ২১ ডিএলআর, ৭৩৩)
ব্যতিক্রমঃ চেয়ারম্যানের উপর নোটিশ জারি না হওয়া সত্ত্বেও পক্ষদের আচরণে প্রমাণ হলে প্রদত্ত তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। (৩ বিএলটি, ৪০)।
চেয়ারম্যানকে তালাক নোটিশ না দিলেও নির্ধারিত সময় পরে স্বামী প্রদত্ত তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। (৩ বিএলটি, পৃষ্ঠা-৪০)।
২. কোন ব্যক্তি উপরের ১ নং উপ-ধারার বিধান লংঘন করলে সে এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ডে বা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে কিংবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হইবে।
৩. তালাক বাতিল না করলে (১) উপ-ধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত হলে তালাক কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।
৪. তবে নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পুনর্মিলনের) জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থায় অবলম্বন করবে। (তবে সমঝোতার ৯০ দিন সময় চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে শুরু হয়। তালাক দেয়া বা নোটিশ লেখার তারিখ থেকে শুরু হয় না। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)।
উল্লেখ্য, নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন না করলে আইনে চেয়ারম্যানদের কোন শাস্তির ব্যবস্থা কিংবা জবাবদিহিতা নেই। এ সুযোগে অনেক চেয়ারম্যান সালিশী পরিষদ গঠন করে না। ফলে নোটিশ প্রাপ্তির ৯০ দিন পার হলে তালাক আপনা আপনিই কার্যকর হয়ে যায়।
৫. তালাক ঘোষণাকালে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে বা অন্তঃসত্ত্বা থাকলে উপরের ৩ নং উপ-ধারায় উল্লেখিত সময় অথবা গর্ভাবস্থা-এ দুইটির মধ্যে দীর্ঘতরটি অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। (তালাকের পর ২৮০ দিনের মধ্যে সন্তান জন্ম হলে সে সন্তান বৈধ। সন্তান বৈধ নয় প্রতিপক্ষকেই তা প্রমাণ করতে হবে। ( সেকশন ১১২, সাক্ষ্য আইন)।
৬. অত্র ধারা অনুযায়ী কার্যকরী তালাক দ্বারা যার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে, সে স্ত্রী এ জাতীয় তালাক তিন বার কার্যকরী না হলে কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে বিবাহ না করে পুনরায় একই স্বামীকে বিবাহ করতে পারবে।
উল্লেখ্য, যে কোন ধরনের তালাক রেজিষ্টেশনের ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিষ্ট্রার বা কাজী সাহেবকে ২০০ (দুই শত) টাকা ফি প্রদান করে তালাক রেজিষ্ট্রি করতে হবে। (১৯৬১ সালের ২৯শে আগষ্ট তারিখের গেজেট নোটিফিকেশন)। ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রেশন) আইন এর ধারা ৬ মোতাবেক তালাক রেজিষ্ট্রেশন করা প্রয়োজন। যিনি বিবাহ রেজিষ্ট্রি করবে তারাই তালাক রেজিষ্ট্রি করতে পারবে। কোন বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হবার পর নিকাহ রেজিস্ট্রার সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে নিকাহনামা বা তালাকনামার সত্যায়িত প্রতিলিপি প্রদান করবেন এবং ঐরূপ সত্যায়িত প্রতিলিপির জন্য কোন ফি আদায় করা যাবে না (ধারা-৯)।
তবে তালাক রেজিষ্ট্রি না করলে, কোন শাস্তির ব্যবস্থা আইনে উল্লেখ নেই। তবে তালাক রেজিষ্ট্রি না করলে তালাক কার্যকর হবে না-এমন কোন কথা আইনে বলা নেই। কাজেই আপনি ঘরে বসে নিজেই ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর ৭ ধারার বিধান মতে সাদা কাগজে তালাকের বিষয় লিখে নিজ হাতে রেজিষ্ট্রি ডাকে এডি সহযোগে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান ও যাকে তালাক দেওয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তিকে নোটিশ দিলেই হবে। এক্ষেত্রে নিকাহ রেজিষ্টার কাজীর কাছে যাওয়ার দরকার নেই। শুধুমাত্র নোটিশ পাঠানোর নব¦ই দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসগুলো নিয়ে স্থানীয় কাজীর কাছ থেকে তালাক রেজিষ্ট্রি করিয়ে নিতে পারেন। তবে বাধ্যতামূলক নয়।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ঊসধরষ: Email: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮