এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
প্রকৃতিগত কারণে একজন নারী একজন পুরুষ থেকে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। এ সুযোগে কিছু পুরুষ তাদের প্রত্যাশিত আচরণ রীতি ভুলে গিয়ে নারীদেরকে অসৎ কাজে ব্যবহারে উদ্যোগী হয়। এতে নারীরা হয় নির্যাতিত, নিষ্পেষিত অধিকারচ্যূত। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ এর ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন ভীতি প্রদর্শন করিয়া বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসঙ্গম করে তাহা হলে তিনি কোন নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে’। অর্থাৎ ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।
সাজার ধরণ দেখে একথা ষ্পষ্ট করে বলা যায় যে, একজন ধর্ষণকারী পশুরও অধম। এখন দেখা যাক, একটি ধর্ষণ মামলায় অপরাধীর দোষ প্রমাণের মাপকাঠি কী? উত্তর হওয়া উচিত ধর্ষিতার সাক্ষ্যই যথেষ্ট। অথচ এ সহজ উত্তরটির অধিকারিণী হতে বাংলাদেশের নারী সমাজকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে।
বিচারপতি গোলাম রাব্বানী স্যারের লেখা এক কেইস ষ্টাডি থেকে জানা যায়, ১৯ বছরের এক গরীব যুবতী গৃহবধূ সালমা। শীতের এক রাতে ওই গৃহবধূ পিতৃগৃহ থেকে রিকশায় চেপে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ঢাকার মিরপুরে সনি সিনেমা হলের কাছে পৌঁছালে চারজন লোক তাঁকে জোরপূর্বক রিকশা থেকে নামিয়ে অস্ত্রের মুখে এক বাড়িতে নিয়ে যায়। রিকশাওয়ালাকে মারলে ও ভয় দেখালে সে পালিয়ে যায়। এরপর সেখানে নিয়ে ড্রইংরুমের মধ্যে তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ চারজনের মধ্যে তিনজনকে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করে ও অবশেষে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ আদালতে তাদের বিচার করা হয়। আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ও আরো দাবি করে যে সালমা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় পতিতাবৃত্তি করে এবং এ অবৈধ কাজে বাঁধা দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এ মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।
আদালতে সালমা আরজীর বিষয় বর্ণনা ও সমর্থন করে সাক্ষ্য প্রদান করেন। ওই ঘর থেকে পুলিশ টিভি, ভিসিআর, ক্যাসেট ও বন্দুক সিজ করে। সিজ করা টিভি ও বন্দুক কোর্টে প্রদর্শিত হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক সালমাকে পরীক্ষা করেন এবং তিনি আদালতে সাক্ষী দেন যে, সালমার পাঁজর, ঊরু, নিতম্বে আটটি জখম, অর্থাৎ ধস্তাধস্তির চিহ্ন পেয়েছেন এবং তাঁকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়েছে। মামলায় আরো ছয়জন সাক্ষী দেন। তাঁরা হলেন এজাহারের লিপিকার দারোগা, থানার ভারপ্রাপ্ত দারোগা, একজন সহকারী দারোগা ও একজন কনস্টেবল। অপর দুজন সিজারলিষ্টের সাক্ষী যাদের উপস্থিতিতে ঘটনাস্থল থেকে টিভি, ভিসিআর, ক্যাসেট ও বন্দুক জব্দ করা হয়েছিল।
সাক্ষ্য ও প্রমাণাদির ভিত্তিতে ওই বিশেষ আদালত আসামি তিনজনকে ধর্ষণের অপরাধে দোষী করেন এবং জরিমানাসহ সাত বছর সশ্রম কারাদ- দেন। এরপর দ-প্রাপ্তরা সাজার আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আপিল করে। বিচারপতি নঈমুদ্দিন আহম্মদ ও বিচারপতি গোলাম রাব্বানীর দ্বৈত বেঞ্চে বসাকালীন আপিলটির শুনানি হয় এবং নিম্ন আদালতের রায়টি সঠিক আছে বলে ওই বেঞ্চ আপিলটি ডিসমিস করে দেন। সেই সাথে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেন যে, যেহেতু ধর্ষিতা নিজেই জখমী, কাজেই তাকে জখমি সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সুতরাং ধর্ষিতাকে একজন সহযোগী ও তাকে অন্য সাক্ষী দ্বারা ঘটনাটিকে প্রমাণ করতে হবে এমন প্রাচীন আইনি ধারণা সঠিক নয়।
মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের উক্ত রুপ রায় ও আদেশের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়ে আসামী পক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করে। আপিল বিভাগ প্রাচীন আইনি ধারণাটি অনুসরণ করে রায় প্রদান করেন। এই রায়ে বলা হয়েছে ‘এই মোকদ্দমার একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী সালমা নিজেই ভিকটিম হওয়ায় এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হবে সালমা সত্য কথা বলেছে কি-না এবং তাঁর সাক্ষ্যের প্রত্যক্ষ বা অবস্থানগত সমর্থন প্রয়োজন কি-না।' অতঃপর সালমার ও অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে আপিল বিভাগ সালমাকে অবিশ্বাস করেন। ফলে আপিল বিভাগ ঢাকার তৃতীয় বিশেষ আদালতের রায় এবং মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাতিল করেন ও আসামি তিনজকে বেকসুর খালাস দেন। আপিল বিভাগের ওই রায়টি পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনস'-এর ১৩০০ খ-ের ৭৯৮৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে।’
আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য যা ২৮ বিএলডি (হাইকোর্ট ডিভিশন) ২০০৮ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দুবার বিয়ে হয়েছিল। তাকে তার নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল এবং এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উল্লিখিত কারণে বাদিনীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।’
ধর্ষণ মামলায় ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে অভিযুক্তের পক্ষ থেকে দেয়া সাক্ষ্য কতটুকু গ্রহণ করা যাবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইন্ডিয়ান ল’ কমিশনের ৮৪ তম রিপোর্টে (১৯৮০) বলা হয়েছে, ধর্ষিতার অতীত যৌন ইতিবৃত্ত সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়ার বিষয়টি লিগ্যাল সিস্টেম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ এবং আইনি-কার্যধারা হতে অনীহা অনুভব করার অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান যা ২৫ বিএলডি (এডি) ২০০৫) মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, ‘বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com