শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৫ অপরাহ্ন
কে এম মাহ্ফুজুর রহমান মিশু:
গতকাল ১৫ জুলাই সীমান্ত দিয়ে ভারতে বোড়কা পড়ে পালনোর সময় ধুরন্ধর সাহেদ র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোড়জোড়ের মাত্র বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারী উধ্বর্তন নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি মধ্যেই রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের টানা তৃতীয় দফায় সুনাম আর দাপটের সাথেই সরকার চালাচ্ছে। শেখ হাসিনা বৈশি^ক রাজনৈতিক প্রবাহে নিজের দক্ষতা আর প্রজ্ঞায় এক অনুন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। দেশের বৃত্ত ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনীতিবিদদের প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো সরিষার ভিতরেই ভ’ত। সরকারের বিগত ১১ বছরের শাসন আমলে সুযোগ সন্ধানী ডজন ডজন ছদ্মবেশীরা অনুপ্রবেশ করছে। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বরে আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত থেকে শুদ্ধি অভিযানে দুর্নীতি, দুবৃত্তায়নের বিরুদ্ধে যে সব হোয়াইট কালার ক্রিমিনালের মুখোশ যখনই উন্মেচিত হচ্ছে তখনই বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এমন কাজের প্রশংসা না করে ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। সরকারের নজিরবিহীন এই অভিযানে ইতিবাচক বিশ্লেষণ না করে নীতিবাচক দিকই নিয়েই যেন ওনারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোন সরকারের আমলেই শতভাগ শুদ্ধিতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কাঠামো পরিচালিত হয়নি। বরং সেই দিক থেকে হোয়াইট কালার ক্রিমিনালদের এই দমননীতি ইতিহাসে নজির হয়ে থাকবে। সদ্য স্বাধীন দেশের সাড়ে তিন বছরের শাসন আমলে খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির সয়লাব দেখে আফসোস করে বলেছিলেন,‘সবাই পায় সোনার খনি আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ তাই ইতিহাসই বলে আমাদের অনেকেরই রক্তের সাথে দুর্নীতির একটা সংযোগের গন্ধ বেশ পুরানো। বর্তমান বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার হাতে শাসনভার। তিনি নিশ্চয়ই এই দুর্বৃত্তায়নের পথ কে প্রসারিত করবেননা।
সরকারের চলমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক খাতে ঘাপটি মেরে থাকা হোয়াইট কালার ক্রিমিনালদের মুখোশ উন্মোচন বাংলাদেশ জনগনের হৃদয়ের গভীর আকাঙ্খার প্রতিফলন। মুখোশ লেবাসধারী এই প্রাণীরা সভ্য ভব্য আর মুখে জনদরদী প্রেমভাবাপন্ন আওড়ালেও ওরা মনের কথা প্রাণের লোককেও বলবেনা। মুখোশের আড়ালে ওদের আসল রুপ নিরূপন নেহায়তই কঠিন ব্যাপার। জটিল তারে জড়িয়ে ফেলা এই ছদ্মবেশী অপরাধীদের বিষয়ে প্রখ্যাত অপরাধ বিজ্ঞানী E. H Sutherland বলেন Crime committed by a person of high social status and respectability in the course of his occupation’ (Sutherland 1949,p.9) সুতরাং উচ্চ শ্রেণীর এই হোয়াইট কালার ক্রিমিনালেরা অপরাধ সংঘঠন করে নিতান্তই অভাবের কারণে নয় বরং স্বভার আর সৌখিনতায়। শেখ হাসিনা সরকার নিজের ঘর থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে চলমান জিরো টলারেন্সের সময়োচিত এই সিদ্ধান্ত সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নতুন আশা ও উদ্দীপনা তৈরী হয়েছে। চলমান এই দমননীতির মাধ্যমে হাল আমলের রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় মাইলফক হিসেবে চিহ্নিত হবে। এতে রাজনীতিতে কোনঠাসা ক্লিন ইমেজের মানুষগুলোর দিগন্ত যেমন প্রসারিত হবে তেমন ভাবে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। সরকারের প্রতিটি বিভাগ কে দুর্নীতিমুক্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আর শক্তিশালী করার পাশাপাশি ৭২ সালের মূল মহান সংবিধানে ৭৭ অনুচ্ছেদ কার্যকর করে গণতান্ত্রিক উন্নত রাষ্ট্রের মত বাংলাদেশও দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখতে পারে। যদিও আমাদের দেশে ১৯৮০ সালে ন্যায়পাল পদ সৃষ্টি হলেও এখন পর্যন্ত আইনটি কার্যকর হয়নি। অত্র ৭৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,‘সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন। সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারী কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের যে কোন কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, সেইরূপ ক্ষমতা বা দায়িত্ব পালন করিবেন।’
চিহ্নিত কালো রংয়ের অপরাধীদের সকলে চিনে এবং ঘৃণার চোখে দেখে। দেশের আইন শাসন বিচার ব্যবস্থা ওদের বিচারের মুখোমুখি করে। আইনও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। কিন্ত ভদ্রবেশী অপরাধীদের বিচার মুখোমুখি করার জন্য সুস্পষ্ট কোন আইন নেই। এই অপরাধীদের আচরণ ভব্য ও সভ্য জাতীয়। তাই সামাজিক জীবনে চুরি, চামারি, ছিনতাই ছেড়ে ওরা শরীরে ভদ্রতার প্রলেপ দিয়ে বনে গেছে হোয়াইট ক্রিমিনাল। রং পাল্টিয়ে হয়ে গেছে বড় বড় রাজনৈতিক নেতা। দিনে দিনে ওরাই হয়ে ওঠেছে অদৃশ্য শক্তির গডফাদার। আইন বিজ্ঞান বিশ্লেষণে এমন অপরাধ তিনটি প্রক্রিয়ার সমন্বয় থাকতে হয়। প্রথমত; দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিকরণ এই প্রক্রিয়ায় অপরাধীরা আইনী ঝামেলা ও নির্দিধায় চলাফেরা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক নেতার পাশে ভিড়তে থাকে এবং আষ্টপৃষ্টে বেধে ফেলে। দ্বিতীয়ত; রাজনীতিবিদদের দুর্বৃত্তিকরণ হলো অপরাধ প্রবণের মানসিকতা সম্পন্ন নেতা সমাজে দখলবাজী, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী ও নিজেকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রাখতে দলের বাইরে নিজস্ব একটি অদৃশ্য বলয় তৈরী করে। এজন্য প্রত্যন্ত এলাকার সকল ছোট খাটো চোর ছেছড়া অপরাধীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্তকরণ করে। আর এই দুই প্রক্রিয়ার কার্যক্রম অবাধে সম্পন্ন করতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে সখ্যতা তৈরী করে। এই প্রক্রিয়াকে দুর্বৃত্তায়নের পুলিশ বলে। মূলত এই তিন প্রকারের সমন্বয় না হলে অপরাধের একটি শক্ত বলয় তৈরী হয়না।
গত ৯ জুলাইয়ের পর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডা: সাবরিনা ও সাহেদ করিমের নাম ফলাও করে প্রকাশিত হচ্ছে। বহুরূপী এই প্রতারক ব্যাংকের চেকে ২৫ ধরনের স্বাক্ষরের প্রমাণ পেয়েছে র্যাব। যে সব স্বাক্ষর ব্যবহার করে বিল পরিশোধ করতেন এই বাটপার। ইতোমধ্যে সারা দেশে ৫৬ টি চেক প্রতারণার মামলাও হয়েছে। আতঁকে উঠার মত ব্যাপার এসএসসি পাশ করা এই বাটপার সবার নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরালো কিভাবে? ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুর্খাজি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা সহ উধ্বর্তন এমন কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নেই যাদের সাথে এই ভন্ডের ছবি আর কমবেশী সখ্যতা নেই। রাতের টকশোতে আবার নীতিবাক্যের সবক দেওয়ার নজিরও কম নেই। এসব দুর্বত্তের শক্তি হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সিদকাটা চুরির শিল্পে পরিবর্তন ঘটিয়ে এইসব হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল রাতারাতি বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছে। এই ছদ্মবেশী অনুপ্রবেশকারীরা আসলে কোন দলের নয়। ওরা সন্ত্রাস। এরা সময়ে রং পাল্টায়। এই চক্রের লেদা অপরাধীরা আইনের জালে আটকা পড়লেও গডফাদারা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। সময় এসেছে গোড়া উপড়িয়ে ফেলার।
অতি সম্প্রাতিক বাংলাদেশের কয়েকটি বিমানের ফ্লাইট করোনা নেগেটিভের আমলনামার সনদ নিয়ে বিদেশে গেলে কভিড-১৯ পজেটিভ অভিযোগে বিমান ফ্লাইট ফেরত দেওয়া হয়। এমন অবস্থা শুধু চীনের গুয়াংজু বিমান বন্দরেরই নয়। ইতালি, জাপান শুধুমাত্র বিমান ফেরতই পাঠায়নি নির্দিষ্ট সময় সাপেক্ষে সব ফ্লাইট বন্ধও করে দেওয়া হয়েছে। বর্হিবিশ^ থেকে বিচ্ছিনের এই অবদান কার? নি:সন্দেহে এই রকম বহুরূপী সাহেদের নয়কি? ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখেছি প্রতিটি সরকারের আমলেই এক ধরণের স্বার্থান্বেষী মহল দলের বাইরে নিজস্ব একটা বলয় তৈরী করে। দলের নাম সীল ব্যবহার করে অপরাধের স্বর্গরাজ্য তৈরী করে কালো জগতের বাদশাহ হয়ে উঠেন। দুধ কলা দিয়ে পোষা সাপ দিনশেষে দলের গোষ্ঠী উদ্ধার করার ইতিহাস কম নেই।
আলো আধারের বাসস্থান একই বৃত্তে থাকতে পারেনা। সদ্য স্বাধীন দেশে শিক্ষিত মার্জিত রূপধারীদের দুর্নীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু যেমন এক ভাষণে বলেছিলেন,‘ আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক না? তো কে? ঘুষ খায় কারা? বিদেশী এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? স্মাগলিং করে কারা? এই আমরা যারা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত এই আমাদের মধ্যেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ লোক এবং এই আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে। আত্মসমালোচনা করতে হবে।’‘ পর্যায়ক্রমিক এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সময় সময় গর্জে উঠলেও বঙ্গবন্ধু কন্যার এখন ছদ্মবেশী অপরাধীদের নির্মূল করা সময়ের দাবী। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যেমন মার্গারেট থ্যাচার, ইন্দিরা গান্ধী, এঞ্জেলা মার্কেলের মত মহামতি নারী শাসকদের চেয়েও দীর্ঘমেয়াদী শাসনকাল ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন। ঠিকই একই ভাবে এই হোয়াইট কালার ক্রিমিনালদের দমন করে বিশ^ দরবারে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে মাথা উচুঁ করে দাড়াবার মত সক্ষমতা তৈরী হবে সেই প্রত্যাশায়।
লেখকঃ কে এম মাহ্ফুজুর রহমান মিশু, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী,অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
মোবাইল: ০১৭২৩২১২৮২৭, Mahfujiub@gmail.com