বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৫৬ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
ওষুধ হলো এমন রাসায়নিক দ্রব্য যা প্রয়োগে প্রাণিদেহের রোগ প্রতিকার হয়। কিন্তু সেই ওষুধ যখন প্রাণীদেহে ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধি সৃষ্টি করে, তখন নিরাপত্তা কোথায়? সম্প্রতি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ টাপেন্টাডলকে মাদকদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। গত ৮ জুলাই এ সংক্রান্ত একটি গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। ব্যথার ওষুধের উপাদান ‘টাপেন্টাডল’ মাদকদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করায় ওষুধ কোম্পানিগুলো এ উপাদানটি ব্যবহার করে আর ট্যাবলেট উৎপাদন করতে পারবে না। গেজেটে এই ওষুধকে মাদকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করায় একে ‘খ’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রস্তাবমতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সুপারিশের ভিত্তিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৫ ধারা মোতাবেক উক্ত আইনে ‘খ’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য হিসেবে টাপেন্টাডলকে সিডিউলভুক্ত করা হলো। ফলে ‘টাপেন্টাডল’ গ্রুপের সকল ওষুধ এখন থেকে মাদকদ্রব্য হিসেবে গণ্য হবে।
এখন জেনে নিই মাদকদ্রব্য কি? মাদকদ্রব্য হচ্ছে এমন দ্রব্য, যা খেলে নেশা হয়। আর যখন কেউ এসব দ্রব্যাদির উপর নেশাগ্রস্থ হয়, তখনই তাকে মাদকাসক্ত বলা হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়। এই আইনের ৯ ধারায় বলা আছে, অ্যালকোহল ব্যতীত অন্যান্য মাদকদ্রব্যের উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার হয় এমন কোনো দ্রব্য বা উদ্ভিদের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন বা পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি করা যাবে না। আরও বলা হয়েছে এ জাতীয় মাদক সরবরাহ, বিপণন, কেনা-বেচা, হস্তান্তর, গ্রহণ-প্রেরণ, লেনদেন, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ ও প্রদর্শন করা যাবে না। সেবন অথবা ব্যবহারও করা যাবে না।
আইনের এই ৯ ধারা লঙ্ঘনে কী ধরনের সাজার বিধান রয়েছে সে সম্পর্কে আইনের ৩৬ ধারায় বিশদ বলা হয়েছে। এই ধারায় বলা আছে, কোথাও পপি ফল বা পপির অঙ্কুরোদ্গম বীজ পাওয়া গেলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে কোথাও ১০টি বা তার কম পপি গাছ অথবা এই গাছের ফল বা বীজ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দেওয়া যাবে। গাছের সংখ্যা ১১ থেকে ১০০ এর মধ্যে হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড এবং গাছের সংখ্যা ১০০ এর বেশি হলে কমপক্ষে ১০ বছর ও সর্বোচ্চ ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া যাবে।
আফিম বা আফিম দ্বারা তৈরি নেশাদ্রব্য ১০০ গ্রাম বা তার বেশি হলে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদ- ও অর্থদন্ড দেওয়া যাবে। একই নেশাদ্রব্যের পরিমাণ ১০০ থেকে ১ হাজার গ্রামের মধ্যে হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড এবং ১ হাজার গ্রামের বেশি হলে ১০ থেকে ১৫ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দেওয়া যাবে।
৫ গ্রাম পর্যন্ত কোকেন, হেরোইন, মরফিন ও পেথিডিন পাওয়া গেলে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদ- ও অর্থদ- দেওয়া যাবে। এই মাদকের পরিমাণ ৫ থেকে ২৫ গ্রামের মধ্য হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড এবং মাদকের পরিমাণ ২৫ গ্রাম বা তার বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড ও অর্থদন্ড দেওয়া যাবে।
ইয়াবা বা অ্যামফিটামিনের উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন বা পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, ১০০ গ্রাম পর্যন্ত ইয়াবা পাওয়া গেলে ১ থেকে ৫ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দেওয়া যাবে। ইয়াবার পরিমাণ ১০০ থেকে ২০০ গ্রামের মধ্যে হলে ৫ থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড দেওয়া যাবে। ইয়াবার পরিমাণ ২০০ গ্রাম বা তার বেশি হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড ও অর্থদন্ড দেওয়া যাবে। ইয়াবা সেবনের শাস্তি ৩ মাস থেকে দুই বছরের কারাদন্ড ও অর্থদন্ড।
আমার এ লেখার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘টাপেন্টা’ ট্যাবলেটের মধ্যে মাদকের উপাদান “অ্যামফেটামিন” আছে মর্মে রাসায়নিক পরীক্ষকের রিপোর্ট পাওয়া যাওয়ার ফলেই গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। এই ওষুধটি এসকেএফ কর্তৃক বাজারজাত করা হয় এবং ঔষধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লাইসেন্স প্রাপ্ত। এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের একটি স্বনামধণ্য ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এবং তারা টাপেন্টা ট্যাবলেট প্রস্তুত ও বাজারজাতকরণের লাইসেন্স প্রাপ্ত। টাপেন্টা ট্যাবলেটগুলো নকল বা এসকেএফ বাংলাদেশ কোম্পানীর নাম ব্যবহার করে অন্য কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই টাপেন্টা ট্যাবলেটগুলো বাজারজাত করছে তারা কিন্তু প্রত্যেকে শাস্তিযোগ্য হবে। যদি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স নিয়ে এসকেএফ বাংলাদেশ কোম্পানি এমন ‘টাপেন্টা’ ট্যাবলেট তৈরি করে যার মধ্যে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের তফশীলভুক্ত মাদকের উপদান ‘অ্যামফেটামিন’ বিদ্যমান, তাহলে উক্ত প্রতিষ্ঠানের যে যে কর্মকর্তা ও কর্মচারী টাপেন্টা ট্যাবলেট উৎপাদনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের সকলেই ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৩ ধারায় দন্ডিত হবে, যেখানে কোম্পানির মালিক, পরিচালক, ম্যানেজার, সচিব অথবা এজেন্টকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিধান রয়েছে। ইয়াবার বিকল্প হিসেবে দির্ঘদিন ধরে ‘টাপেন্টাডল’ গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ যেমন টাপেন্টা, লোপেন্টা, পেন্টাডল, টাপেন্টাডল প্রভৃতি নামে বাজারে থাকা ওষুধগুলো মাদকসেবীরা ব্যবহার করে আসছিল। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স থাকায় উল্লেখিত ওষুধগুলোকে সরাসরি মাদক হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না পুলিশের। কিন্তু এ মাসের ৮ জুলাই মাদকদ্রব্য হিসেবে গেজেট প্রকাশের পর থেকে টাপেন্টাডল উদ্ধারের ক্ষেত্রে মাদক আইনে মামলা দায়েরের আর কোন আইনগত বাঁধা থাকলো না।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮