শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৭ অপরাহ্ন
মাজহারুল ইসলাম:
মানবাধিকার শিক্ষা কি? মানবাধিকার শিক্ষা সাধারণত একটি গ্রহণযোগ্য মানবাধিকার সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এটিকে জনগণকে ক্ষমতায়নের এক উপায় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এধরনের শিক্ষা এমন দক্ষতা এবং আচরণ তৈরি করতে সাহায্য করে যা সমাজের মধ্যে মর্যাদা এবং সাম্যকে উন্নীত করে। ধর্মীয় ও পার্থিব শিক্ষা গ্রহণের অধিকার প্রতিটি ব্যক্তির রয়েছে যার শুরু হয় পরিবার, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে । আর মানবাধিকার শিক্ষা ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করতে, মহান আল্লাহ্র প্রতি নিজের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতে এবং অধিকার এবং কর্তব্য উভয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সহায়তা করে। ইয়েমেন, সিরিয়া এবং আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং মায়ানমার সহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে যা ঘটছে তা মনবধিকার শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছে।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও গুরুত্বঃ
ইতিহাস তৈরি হয়েছিল ফ্রান্সের প্যারিসে, ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর, যখন সদ্য নির্মিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ “মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র” প্রকাশের মাধ্যমে। পরবর্তীতে, সাধারণ পরিষদ, ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ রেজুলেশন ৪৯/১৮৪ মধ্যমে ১৯৯৫-২০০৪ সালকে জাতিসংঘের মানবাধিকার শিক্ষার দশক হিসাবে ঘোষণা করে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র ও ১৯৯৪ রেজুলেশন এই দুটি কেবল মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপরই জোর দেয়নি, এটি অর্জনের অন্যতম উপায় হিসেবে মানবাধিকার শিক্ষার বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছে। ১৯৯৪ সালের ঘোষণাপত্রটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলিকে তাদের স্কুলের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে উৎসাহিত করেছিল।
১৯৯৪ সালে শুরু হওয়া এই প্রচেষ্টা পরবর্তী সময়ে অনেক প্রশংসিত হয়েছিল। যদি সঠিকভাবে মানবাধিকার শিক্ষা প্রয়োগ করা হয়, এটি সহিংস সংঘাতগুলি হ্রাস করতে এবং মানবিক মর্যাদা ও সাম্যের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাতে সফল হবে। ফলস্বরূপ, ২০০৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, রেজুলেশন ৫৯/১১৩এ মাধ্যমে,”মানবাধিকার শিক্ষার জন্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম” শিরোনামে এই বিষয়ে আরও একটি ঘোষণাপত্র দেয়। ২০০৪ এর প্রোগ্রামটি ১৯৯৪ এর রেজুলেশনের পরিধিটি প্রসারিত করতে এবং মানবাধিকার শিক্ষার নীতি ও পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক স্তরের অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করা হয়, যাতে করে তৃণমূল পর্যায়ে মানবাধিকার শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
মানবাধিকার শিক্ষা প্রদানে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনমূলক ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে ইউনেস্কো, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস এডুকেশন অ্যাসোসিয়েটস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের সিলেবাসে মানধিকার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে শেখানো হচ্ছে। ইউরোপে, বেশ কয়েকটি স্কুল তাদের পাঠ্যক্রমের অংশ হিসাবে মানবাধিকার শিক্ষা প্রদান করে যাচ্ছে। এতে মানবাধিকার তত্ত্ব, মানবাধিকার চর্চা, এবং সমসাময়িক মানবাধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলি পড়ানো হচ্ছে।
সাধারণভাবে, মানবাধিকার কোর্সগুলি তিনটি পৃথক ভাবে প্রদান করা হয়ে থাকে।
সচেতনতা মূলকঃ মানবাধিকার বিষয়গুলির প্রাথমিক জ্ঞান এবং মূল্যবোধের সাথে এর সম্পর্ক কি, এবং কি ভাবে মানবাধিকার ভোগ করা যায় এসকল বিষয়ের উপর আলোকপাত করে। এই মডেলটির লক্ষ্য ও শ্রোতা হচ্ছে সাধারণ জনগণ।
জবাবদিহিতা মূলকঃ মানবাধিকার সম্পর্কিত আইনী এবং রাজনৈতিক পদ্ধতির আলোচনা হয়ে থাকে। এই মডেলটিতে প্রশিক্ষনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আদালতের মামলা পরিচালনা, আইনের ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষন প্রদান করা হয়ে থাকে।
বিশেষ মডেলঃ এটি বিশেষত নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য। মানবাধিকারের মনস্তাত্ত্বিক এবং অর্থনৈতিক দিক গুলি কে কেন্দ্র করে এটি পরিচালিত হয়ে থাকে। এই মডেলটির লক্ষ্য হচ্ছে, যারা ক্ষয়ক্ষতি এবং আঘাতের শিকার হয়েছে তাদের অধিকার সচেতন করে তোলা এই অপব্যবহার রোধ কল্পে পদক্ষেপ নেওয়া।
মানবধিকার শিক্ষার সুবিধা গুলি নিম্নরূপঃ ব্যক্তিকে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান, প্রচার ও রক্ষার বিষয়ে সচেতন করে; এটি মানবাধিকারের প্রতি সার্বজনীন প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধা জোরদার করে; এ জ্ঞান একজনকে তার অধিকারগুলির সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করে এবং অপব্যবহারকারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে; এটি জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা, এবং ভাষা নির্বিশেষে মানুষের মর্যাদা ও সাম্যের প্রতি সম্মান ও সহনশীলতার কথা প্রচার করে; এটি ব্যক্তিকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহ দেয়; এটি বর্ণ বা ধর্মের ভিত্তিতে উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে শেখায়।
ফলস্বরূপ, মানবাধিকার শিক্ষা প্রত্যেকের অধ্যয়ন করা উচিত বিশেষত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, আইনজীবি, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ এবং কারাগারের নিয়োজিত ব্যক্তিদের। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা এর সদস্য দেশগুলির মধ্যে মানবাধিকার উন্নয়নে, মানবাধিকার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। এবং ওআইসির স্বতন্ত্র স্থায়ী মানবাধিকার কমিশনের সকল সদস্যকে সক্রিয়ভাবে শিক্ষা বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি বৈঠকে জাতিসংঘের প্রত্যেক সদস্য দেশগুলিকে জাতি, ধর্ম, ভাষা বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে আর যা ১৪০০ বছর পূর্বে মহানবী (স) বলে গিয়েছেন বিদায় হজ্বের ভাষণে। সুতরাং জাতিসংঘের প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রকে তাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবাধিকার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য দ্রুত প্রদেক্ষেপ নেওয়া উচিত।
লেখকঃ পিএইচডি গবেষক, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি, ভারত। ইমেইল talukderlaw@gmail.com