শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৫ অপরাহ্ন
রবিউল আলম বাবুল:
ফেলে আসা অতীত, ভুলে যাওয়া স্মৃতি, হঠাৎ হৃদয়ের মণিকোঠায় উঁকি দিয়েছে। আজ যে মহান মানুষটিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছি তিনি আমাদের খোকসা উপজেলার একতারপুর ইউনিয়নের এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার স্বর্গীয় শিবনাথ ঘোষের পুত্র শিশির কুমার ঘোষ। স্কুল জীবনে ২য় হওয়ার গৌরব মেলেনি এ মেধাবী মানুষটির। ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ পেয়ে ক্লাস সিক্সে তিন সেকশনে ১০০ ছেলেমেয়ের মধ্যে ১ম হয়ে ৭ম শ্রেনীতে উঠার পরে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্কুল এবং কলেজ জীবনে সব সময় তিনি ১ম গ্রেডে স্কলারশিপ পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে এসএসসি পরিক্ষার্থী হলেও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ১৯৭২ এর মার্চে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে এটাই ছিল এসএসসির প্রথম ব্যাচ। কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পরে ১৯৭২ সালে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় ৮০০ প্রার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ভর্তি হন কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। তারপর ১৯৭৫ সালে কৃতিত্বের সাথে এ কলেজে থেকে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং (সিভিল) পাশ করেন।
একসাথে ৩ টা চাকরির অফার ছিল। যথাক্রমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, পলিটেকনিকের টিচার ও কেয়ার বাংলাদেশ। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হিসাবে তিনি নিজেকে বেছে নেন ১৯৭৬ সালে। তারপর প্রমোশন পেয়ে জেলা ত্রান ও পূনর্বাসন কর্মকর্তা এবং সেখান থেকে প্রমোশন পেয়ে উপ-পরিচালক দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা মহাপরিচালকের অফিসে যোগদান করেন এবং ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি চাকরি থেকে অবসরে যান।
বর্তমানে ছেলে ( বিএসসি ইঞ্জিয়ার) ও বৌমা (ফার্মাসিটিতে অনার্স মাষ্টার্স)ও এক নাতি ছেলেসহ সস্ত্রীক ঢাকা খিলক্ষেত নিকুঞ্জ -২ এ অবস্থান করছেন। এই গুনী মানুষটির দুটিই ছেলেই বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। দুই ছেলেই ইটিই ও সিএসই’তে চাকরিরত আছে।
অস্বচ্ছল নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষটির কাঁধে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল বলতে গেলে ছাত্রজীবন থেকেই। ৭ ভাই বোনের সংসারে ভাইদের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়। ১৯৭৫ এ বাবা মারা যাওয়ার পরে শুধু সংসারের হালই না, পাঁচটি বোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে সুপাত্রস্থও করেছেন তিনি। সেই সুবাদে বোনের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আজ দেশে এবং বিদেশে স্ব স্ব অবস্থানে চাকরিরত আছে। পরিবারে অন্যান্যদের উচ্চ শিক্ষালাভ ও ভাল চাকুরী সব তারই অবদান। সমাজ সেবামূলক কাজেও তিনি নিজেকে নিয়জিত রাখতেন। চাকরি জীবনে এলাকার মানুষের জন্য সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। তার নিজ এলাকার স্কুলে ‘ ঈশ্বরদি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ‘ এ পাঁচ বছর টানা সভাপতি ছিলেন এবং ১৯৯৯ সালে তার কষ্টার্জিত সঞ্চিত ডিপিএস ভাঙিয়ে পুরো অর্থটাই স্কুলের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহার করেন।
এই গুনি ব্যক্তিটি আমার বড়ভাই ইঞ্জিনিয়ার মরহুম শহিদুল আলম চুন্নুর ক্লাসমেট। ছোট বেলায় হালকা কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। দাদাকে আমার ভাইয়ের সাথে মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িতেও দেখেছি, তবে খুবই অস্পষ্ট। দাদার একটি বিষয়ই শুধু আমার মনের মনিকোঠায় এখনো জায়গা দখল করে আছে সেটি দাদার অভিনয় নৈপুণ্য পারদর্শিতা! সে সময়ে নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য কোন নারী শিল্পী পাওয়া যেত না। সেকারণ সুদর্শন ছেলেকেই বেছে নেওয়া হতো নারী চরিত্রের জন্য। দাদার গুন শুধু পড়াশোনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা,রূপও ছিল নায়িকা হওয়ার মতো!
আমার দিব্যি মনে আছে দিয়ানত স্যারের পরিচালনায় “সাগর সেঁচা মানিক” এ দাদাকে মুক্তা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের বাহবা নিতে!!দাদার বিপরীতে নায়কের অভিনয় করেছিলেন দাদাদেরই ক্লাসমেট আব্দুস সালাম।
এসব ঘটনা সবই ১৯৭২ সালের। তখন আমি ১০/১১ বছরের। স্মৃতিতে মাঝে মাঝে ধরা দেয় আবার হাড়িয়ে যায়। দাদার কলেজ লাইফে আবার যাত্রামঞ্চে নায়ক চরিত্রেও দেখেছি। তারপর থেকে দাদার সাথে আর যোগাযোগ ছিলনা। ফেসবুকের কল্যাণে অল্প কিছুদিন হলো দাদাকে খুঁজে পেয়েছি। তবে পরিচয় দিতে হয়েছে,” আমি চুন্নুর ভাই”! পরিচয় পেয়ে দাদার অনুভূতি এবং আন্তরিকতা ছিল এমনি, মোবাইল ছেদ করে আমাকে জড়িয়ে ধরা!!
অনেক স্মৃতিচারণ করলেন আমার সাথে। একে একে অনেক ক্লাসমেটদের কথায় বললেন। তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েক জনের নাম এবং তাদের মেধা নিয়েও আলোকপাত করলেন। তন্মধ্যে মদন মোহন বিশ্বাস, ঢাকা আইডিয়াল কলেজ শিক্ষক থেকে অবসরপ্রাপ্ত। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া। ষষ্টি সরকার, বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা। ইঞ্জিনিয়ার মরহুম শহিদুল আলম চুন্নু, আরজ আলী, সামছুল আলম আক্কাস, আব্দুস সালাম, বিশাখা রায়, আয়েশা, সেবা, মুক্তা, রেখা, প্রমুখ। একে একে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার মরহুম ভাই শহিদুল আলম চুন্নুর কথা বলতে গিয়েই দাদার কন্ঠ আড়ষ্ট হয়ে গেল! দু’জনেই নিঃস্তব্ধ, শুধু ভারী দীর্ঘশ্বাস!!
লেখকঃ ঢাকাস্থ খোকসা উপজেলা কল্যাণ সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজ কর্মকার।