বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪২ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
উত্তারিধার সুত্রে আমরা এখনও বৃটিশদের প্রথা অনুসরণ করে আসছি এবং বৃটিশদের প্রথা অনুযায়ী আদালতের মর্যাদা ও পবিত্রতা আরও সংরক্ষিত। আদালত হলো পুরো বিচার ব্যবস্থার কেন্দ্র বিন্দু। “রাজা কোন ভুল করতে পারেনা” এই অনুশাসন বাক্যটির মধ্যেই বিচার ব্যবস্থার এই ধারণা এখনও নিহিত রয়েছে।
ইউনূস আলী আকন্দ, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী। আদালত অবমাননার দায়ে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অপরাধ, আদালত নিয়ে নিজের ফেইসবুক আইডি থেকে তিনি একাধিক পোস্ট দিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। সেকারণ, তাঁকে ২৫ হাজার টাকা অর্থদ- এবং অনাদায়ে তাকে পনেরো দিনের কারাদ- ও তিন মাসের জন্য আইন পেশা পরিচালনা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। মূলত, সংবিধানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করে বলা হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাঁধা-নিষেধ সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় সব নাগরিকের বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হলো। বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবিদার; কেননা বিধান মোতাবেক আদালত অবমাননা দুটি শ্রেণীতে পড়তে পারে, যথা দেওয়ানি আদালত অবমাননা ও ফৌজদারি আদালত অবমাননা। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো দেওয়ানি আদালতের দেয়া রায়ে ডিক্রি, আদেশ, রিট অথবা আদালতের পরোয়ানা অমান্য কিংবা আদালতের দেয়া কোনো রায় বা মুচলেকা ভঙ্গ করে থাকেন তবে সেটা আদালত অবমাননা হতে পারে।
২০০৭ সালে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি বিধির কন্টেম্পট পিটিশন নং ৯৫৭১/২০০৭ (রাষ্ট্র বনাম আদালত অবমাননাকারী) মামলায় স্বয়ং মহামান্য বিচারপতি আদালত অবমাননা সম্পর্কে রায় প্রদান করতে গিয়ে উল্লেখ করে বলেছেন, বিচারকরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় তবে সে সমালোচনা সংযত ও বস্তুনিষ্ঠ হওয়া দরকার। একজন বিচারকের রায় নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা করতে আইনগত কোনো প্রকারের বাধা নেই। কিন্তু প্রদত্ত সে রায়ের কারণে বিচারককে ব্যক্তিগতভাবে সমালোচনা করা যাবে না। প্রত্যেকের বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় আইন বিচারকদের এতটুকু নিরাপত্তা জনগণ ও রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে প্রদান করেছেন। যদি সে রকমটা না হতো তবে বিচারকের মতো সর্বাধিক গুরুদায়িত্ব পালন করতে কেউ রাজি হতেন না। বিচারকের রায়ে যদি কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হয় এবং সে যদি মনে করে তবে সে ন্যায়বিচারের প্রাপ্তির জন্য উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবে।
আঠারো শতকের প্রথম ভাগে মহামান্য বিচারপতি Lord Robertson বলেছিলেন in the absence of immunity, no man but a beggar or a fool would be a judge.কাজেই প্রচলিত আইন ও আদালতকে সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের দায়িত্ব।
বিচারকদের দায়িত্ব কোনো মামুলি দায়িত্ব নয় বরং গুরু দায়িত্ব। বিচারকের কাজের সঙ্গে চিকিৎসকের কাজের তুলনা করলে ভুল হবে না। ২০০৭ সালে মহামান্য হাইকোর্ট আদালত অবমাননা আইনের মামলায় রায় প্রদানকালে মন্তব্য প্রদানকালে বলেন, প্রতিটি চিকিৎসক জীবন্ত মানুষের হৃদয়ে, মস্তকে বা শরীরের অন্যান্য বিশেষ অপরিহার্য ও সংবেদনশীল অঙ্গে অপারেশন করার সময় তার সম্পূর্ণ মনোযোগ শুধু অপারেশনে নিয়োজিত করে থাকেন। কেননা তিনি জানেন তার মনোযোগের সমান্যতম বি ঘটলে রোগীর প্রাণহানি ঘটতে পারে। যদি কোনো কারণে সে চিকিৎসক সমালোচনার সম্মুখীন হন কিংবা ভীত হয়ে যান তবে তার পক্ষে যেমন অপারেশন করা দুরূহ হয়ে পড়বে ঠিক তেমনি বিজ্ঞ বিচারকরা যদি সমালোচনার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন তবে তা হলে বিচারকার্য অবিচারে পর্যবসিত হতে পারে। ফলাফল হিসেবে বিচারক সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুদূর প্রসারিভাবে রাষ্ট্রের আপামর জনসাধারণ অপরিসীম ক্ষতির স্বীকার হতে পারেন। সে দিক বিবেচনায় কোনো বিচারক সম্পর্কে কোনো প্রকারের অভিযোগ সৃষ্টি হলে প্রথমে তাকে সে অভিযোগ সম্পর্কে জ্ঞাত করা অপরিহার্য। পরবর্তী সময়ে তার ঊর্ধ্বতন নিয়ন্ত্রণকারী মহামান্য বিচারক মহোদয়কে বিষয়টি জ্ঞাত করা দরকার। যদি প্রয়োজন হয় তবে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির গোচরীভূত করা যেতে পারে। কারণ, কোনো অসৎ বিচারককে কোনো পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগে নিয়োজিত রাখা উচিত নয়।
কাজেই মন্তব্য, সমালোচনা, তদন্ত ও গ্রহণের যুগে বিচার বিভাগ যৌক্তিক ও অনিষ্টবিহীন সমালোচনার হাত থেকে নিরঙ্কুশভাবে অব্যাহতি দাবি করতে পারে না। আদালতের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা হলে তাঁকে তা মেনে নিতে হবে। (৪৪ ডিএলআর, এডি, ১৯৯২, ৩০]। কিন্তু সমালোচনাটি শোভন ভাষায় নিরপেক্ষ, অনুভূতিপূর্ণ, সঠিক ও যথাযথ হতে হবে। সম্পূর্ণভাবে যেখানে সমালোচনার ভিত্তি হচ্ছে সত্যবিকৃতি ও পুরো বানোয়াট এবং বিচারকের ন্যায়পরায়ণতার ওপর কটাক্ষপূর্ণ ও বিচার বিভাগের সম্মান খাটো করা ও জনগণের আস্থা ধ্বংস করে দেয়া এটা উপেক্ষা করা যায় না। যেহেতু আইনের মহার্ঘতা অবমাননাকারীদের দ্বারা কালিমা লিপ্ত করার অনুমতি দেয়া যায় না।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কতৃক মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষনা পত্র গৃহীত হয়। সে ঘোষনার ধারা-১৯ এ বলা হয়েছে, প্রত্যেকেরই মতামত পোষন করা ও প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া মতামত পোষন করা এবং যে কোনো সংবাদ মাধ্যমের ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত চাওয়া, গ্রহণ করা ও জানাবার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
আমেরিকা সহ আধুনিক বিশ্বের বহু দেশে আদালতের রায়কে সমালোচনা করার অধিকার নিয়ে কথাবার্তা উঠেছে জনস্বার্থে বিচার কার্যের নিরেপেক্ষ ও যুক্তি সংঘত সমালোচনা আদালত অবমাননা নয়।
আদালতের মর্যদা ক্ষুন্ন না করে নিস্পত্তিকৃত মামলা সম্বন্ধে সম্পাদকীয় মন্তব্য অবমাননাকর নয়। মামলা সংক্রান্ত আদলতের কার্যাবলীর কোন কিছু গোপন বা অতিরঞ্জিত না করে ভুল বর্ণনা না দিয়ে যদি সঠিকভাবে প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা যায়। তবে ঐ প্রকাশনা আদালত অবমানান কর হবেনা। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সৎ সমালোচনা করা আদালত অবমাননার আওতায় পড়বেনা। রায়ের সৎ ও আইন সম্মত মন্তব্য আদালত অবমাননা নহে। জনস্বার্থে বিচার কার্যের নিরপক্ষে ও যুক্তি সংঘত সমালোচনা আদালত অবমাননা নয়। যখন বিচারকের বিরুদ্ধে অসংঘত উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা করা হয় তখন প্রকৃত সমালোচনার গন্ডি অতিক্রম করা হয়।
এ কারনইে আমরা মাঝে মধ্যে দেখি যে,কোন নির্দিষ্ট আদালতে হয়ত সুবিচার পাবেনা মনে করে কখনও কখনও কোন পক্ষ মামলাটি অন্য আদালতে প্রেরণের আবেদন জানায়। এমনকি সে পক্ষ আদালতের বিচারকের সামনে হাজির হয়ে বলতে পারে যে আমি কারণগুলোর জন্য আপনার কাছ থেকে বিচার পাবোনা। তবে যেকোনভাবেই হোক অবমাননার অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে হলে আদালতের প্রতি সম্মান ও মর্যদা বজায় রাখতে হবে। আদালত অবমাননার দায়ে কারদন্ড বা জরিমানা উভয় দন্ড হতে পারে।
একটি গল্প দিয়ে আমার এ নাতিদীর্ঘ নিবন্ধটি শেষ করতে চাই। লন্ডনে টেমস নদীর পাড়ে বার্নার্ড’শ এক দিন মর্নিং ওয়ার্কে বেরিয়েছেন। উল্টো দিক থেকে এইচ পি ওয়েলসও আসছিলেন। তাঁর হাতে একটা ছড়ি। সেটা তিনি ঘোরাচ্ছিলেন। বার্নার্ড’শর কাছে এসেও তিনি ছড়িটি ঘোরানো বন্ধ করলেন না। বার্নার্ড’শ বললেন, ‘ছড়ি ঘোরানো থামাও। ওটা তো আমার নাকে আঘাত করতে যাচ্ছে।’ ওয়েলস বললেন, ‘আমি এ দেশের একজন স্বাধীন নাগরিক। যেখানে খুশি সেখানে ছড়ি ঘোরানোর নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার আমার আছে।’ বার্নার্ড’শ বললেন, ‘অবশ্যই সে অধিকার তোমার আছে। কিন্তু আমার নাকের ডগা যেখানে শেষ, সেখান থেকে তোমার নাগরিক অধিকারের শুরু।’
বার্নার্ড শর এই মন্তব্য থেকেও বোঝা যায়, একজন নাগরিকের স্বাধীনতারও একটা সীমা ও দায়বদ্ধতা আছে। সেটা অন্য নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটেনে যখন বাকস্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব করে নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, তখন কয়েকজন সম্পাদক বার্ট্রান্ড রাসেলকে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাসেল বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও অস্তিত্ব আমার কাছে এখন বেশি বিবেচ্য। নাগরিক স্বাধীনতা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এই মুহূর্তে আমার কাছে বেশি বিবেচ্য নয়।’
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইলঃ ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com