শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৮ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কিভাবে জামিন নিবেন

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কিভাবে জামিন নিবেন

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে আপনি দু’ভাবে জামিন চাইতে পারেন। ১৯ ধারায় ট্রাইব্যুনালের কাছে জামিনে আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল যদি জামিন না দেয়, তাহলে ২৮ ধারায় উক্ত জামিন না দেয়ার আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করতে পারেন। কারণ ২৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ অথবা রায় অথবা দ-াদেশ দ্বারা সংক্ষুব্ধ পক্ষ উক্ত আদেশ, রায় বা দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করতে পারবেন। উপরোক্ত দু’ধরনের জামিন ছাড়াও অন্য এক ধরনের জামিনের বিধান আছে যা হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক উদ্ভাবিত আগাম জামিন।

ট্রাইব্যুনাল কখন জামিন দিয়ে থাকেনঃ ১৯(৩) উপ-ধারায় বিধানে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি নারী বা শিশু হলে কিংবা শারিরীকভাবে অসুস্থ হলে সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দিলে ন্যায়বিচার ব্যহত হবে না মর্মে ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হলে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবে। তবে দু’টি শর্ত পূরণ করতে হবে। মুক্তি দেওয়ার আবেদনের উপর অভিযোগকারী পক্ষকে শুনানীর সুযোগ দিতে হবে; এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই মর্মে ট্রাইব্যুনালকে সন্তুষ্ট হতে হবে।

জামিন সমস্যা ও একটি বাস্তব কেইস ষ্টাডিঃ
সুমন ও মোহনা ভালবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের ২ বছরের মাথায় এ দম্পতির কোল জুড়ে আসে একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। এরই মধ্যে একটি ঠুনকো বিষয়কে কেন্দ্র করে দু’জনের সংসারে শুরু দাম্পত্য কলহ। রাগের বশবর্তী হয়ে মোহনা বাবার বাড়িতে চলে যায়। সব শুনে মিলে মোহনার পরিবার এবার সুমনকে শায়েস্তা করতে মনস্থির করে। মোহনাকে সাথে নিয়ে তার পিতা রহিম মাতব্বর ছুটেন আদালত প্রাঙ্গনে। আদালত এলাকায় গিয়ে একজন আইনজীবীর সাথে আলাপ করে আইনজীবীর পরামর্শে মোহনার স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করেন। একদিন পরেই কয়েক শ’ টাকা খরচ করে সিম্পল একটি জখমী সনদ সংগ্রহ ও কাজী অফিস থেকে কাবিননামার কপি সংগ্রহ করে আসে আইনজীবীর কাছে। এরপর শুরু হয় মিথ্যার খেলা। মোহনা বাদী হয়ে স্বামী, বৃদ্ধ শ্বশুর ও শ্বাশুরী ৩ জনকে আসামী করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’ এ দুই লক্ষ টাকা যৌতুক দাবীর অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ ২০০০ এর ১১(গ)/৩০ ধারায় একটি নালিশী আরজি দাখিল করেন। বিজ্ঞ বিচারক মোহনার জবানবন্দি শুনে মামলাটি আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ’কে মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করার নির্দেশ দেন। থানার ওসি যথারীতি মামলাটি এজাহার হিসেবে রুজু করে সংশ্লিষ্ট জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট আদালতে প্রেরণ করে। মামলাটিতে চার্জশীট দাখিলের আগ পর্যন্ত স্বামী সুমন ও তার বৃদ্ধ মা-বাবা ওই মামলায় গ্রেফতার এড়াতে ও হাজতে যাওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। কারণ, প্রথমত জামিন অযোগ্য ধারার অপরাধ, দ্বিতীয়ত এ মামলায় জামিন দেয়ার এখতিয়ার সাধারণত নি¤œ আদালতের নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ এর গ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা স্বামীর পক্ষের কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো নারীর সাধারণ জখম করেন তাহলে উক্ত স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি অনধিক তিন বৎসর কিন্তু অন্যূন এক বৎসরের সশ্রম কারাদ-ে দ-নীয় হবেন এবং উক্ত দ-ের অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-নীয় হবেন।
এ প্রেক্ষাপটে মামলা ও হয়রানি থেকে বাঁচতে আসামীরা রীতিরকম বাদী সুমনার সাথে আপোষের চেষ্টা করতে থাকে। সুমনাও নিজ সন্তান ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপোষে রাজী হয়ে যায়। কিন্তু বিধিবাম! এরই মধ্যে স্বামী সুমন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে যায়। মামলার বাদী মোহনা ছুটে যায় থানায়। থানার ওসি ও তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আপোষের কথা খুলে বলেন এবং তার স্বামীকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু এখানে রয়েছে আইনের মারপ্যাচ। ওয়ারেন্টভূক্ত আসামীকে থানা থেকে ছেড়ে দেয়ার সুযোগ নেই। আইনানুযায়ী সুমনকে গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে থানা থেকে সেই সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হয়।

বাদী সুমনা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান আদালতে। সুমনের আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন, বাদী মোহনা ও তার আইনজীবী আদালতে দাঁড়িয়ে ‘আসামীর (স্বামী) সাথে আপোষ-মীমাংসা হয়ে সুখে দাম্পত্য কাটানোর কথা বলে আসামীর জামিনে অনাপত্তির আবেদন জানায়। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচার্যযোগ্য হওয়ায় এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের জামিন দেয়ার এখতিয়ার না থাকায় উভয়পক্ষের শুনানীক্রমে ম্যাজিষ্ট্রেট জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন। সুমন চলে যায় জেল হাজতে। উপায়ান্তর হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন নামঞ্জুরের আদেশের সহিমুহুরী নকল কপি তুলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ‘মিচ’ মামলা মূলে জামিনের আবেদন করেন। নিম্ন আদালতের নথি তলব, জামিন শুনানীর পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ শেষে প্রায় দেড় মাস পর আসামী সুমন কারামুক্তি পায়।
পাঠক! সামান্য দাম্পত্য কলহ থেকে মামলার ঘটনা ও সংযুক্ত জখমী সনদপত্র যে মিথ্যা এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য পন্ডিত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ম্যাজিস্ট্রেটকে জামিন প্রদানের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। জামিন দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বিজ্ঞ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল’কে। অথচ থানায় দায়ের হওয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রতিটি মামলা পুলিশ রিপোর্ট (অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন) দাখিল করার আগ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে থাকে। সেকারণ ধরা পড়লে সহসা জামিনের কোন পথ নেই।

একটি অপরাধ জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য যাই হোক না কেন, যুক্তিসঙ্গত কারণ সাপেক্ষে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জামিন মঞ্জুর বা না-মঞ্জুর করতে পারেন। জামিনযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধে জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় বিবেচ্য, তা সবিস্তারে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা নং ৪৯৬, ৪৯৭ ও ৪৯৮-এ উল্লেখ রয়েছে। এ তিনটি ধারার যৌথ অধ্যয়নে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হল- জামিনযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন লাভ করতে চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা অথবা আদালত আইনজীবী ও স্থানীয় জামিনদার থেকে জামিননামা ব্যতিরেকে অপরাধীর নিজ প্রদত্ত জামিননামায় তাকে জামিনে মুক্ত করতে পারেন।
ম্যাজিস্ট্রেটও যে কোন মামলায় জামিন দিতে পারেন। আইনে কোথাও বাঁধা নেই। অনেক সময় ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারকেরা এ আইনে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক জামিন প্রদানকে তাঁদের এখতিয়ারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে মনে করেন। অনেক সময় ম্যাজিস্ট্রেটদের মৌখিকভাবে সরাসরি নিষেধও করা হয়। এমনকি এ আইনের অধীনে জামিন দেওয়ার কারণে ম্যাজিস্ট্রেটকে কারণ দর্শাতে বলা হয় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবার কখনও সশরীরে বিজ্ঞ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হয়ে। বিষয়টি একজন ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য নিঃসন্দেহে হতাশাজনক, বিব্রতকর এবং অপমানজনক। ফজলুর রহমান বনাম রাষ্ট্র মামলার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিঃসন্দেহে এ আইনে ভিকটিম, এজাহারকারী ও প্রসিকিউশনকে শুনানির যুুক্তিসংগত সময় দিয়ে এবং শুনানি করে যদি অভিযুক্ত অভিযোগে দ-িত হওয়ার পর্যাপ্ত উপাদান নেই বলে মনে করেন, তবে অবশ্যই জামিন দিতে পারেন।

লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel