সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
আমরা সাধারণতঃ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কিংবা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার আশায় অথবা ব্যবসা-বানিজ্য কিংবা পড়াশুনার উদ্দেশ্যে প্রবাসে যেয়ে থাকি। কিন্তু মন তো পড়ে থাকে স্বদেশে। একসময় নাড়ি ও মাটির টানে নিজ নিড়ে ফিরে আসতে হয়। কিন্তু প্রবাস জীবনে স্বদেশে জমি-জমা কেনার যেমন প্রয়োজন হয় তেমনি প্রয়োজন হয় জমি বিক্রয়ের। অনেক সময় আপনি বিদেশ থাকায় এজমালি সম্পত্তির কোনো অংশীদার জমি বিক্রয় করতে পারছে না। প্রচলিত আইন অনুযায়ী আপনি বিদেশ থেকেই দেশের সম্পত্তি বিষয়ক এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তবে ২০০৫ সালের ১ জুলাই থেকে জমির যেকোনো হস্তান্তরযোগ্য দলিল রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে বিক্রেতার পাশাপাশি ক্রেতাকেও দলিল করার সময় উপস্থিত থাকতে হবে। তাই বিদেশে বসে কিংবা অপ্রাপ্ত-বয়ষ্ক ছেলে মেয়ের নামে জমি কেনা এখন আর সম্ভব হয় না।
আপনি বিদেশ থেকে কিভাবে জমি বিক্রয় করবেন
আপনি বিদেশে বসে দেশে রেখে যাওয়া যেকোনো সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারবেন। তবে জমি বিক্রয় করতে হলে আপনাকে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তির উপর ক্ষমতা দিতে হবে। শুধু জমিজমা-সংক্রান্ত নয়, যেকোনো কাজ আপনার অনুপস্থিতিতে সম্পাদনের ক্ষমতা অর্পণ করতে পারেন। এখন প্রশ্ন ও জানার বিষয় হচ্ছে, আপনি বিদেশে থেকে কি কি কাজ করার জন্য আপনার বিশ্বস্থ ব্যক্তির উপর পাওয়ার অব এ্যাটর্নী বা আম-মোক্তার বা ক্ষমতা দিতে পারবেন।
১। দেশে থাকা আপনার জমি বিক্রয় করার প্রয়োজন দেখা দিলে
২। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার বিপরীতে স্থাবর সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক প্রদানের প্রয়োজন দেখা দিলে
৩। আপনার জায়গা জমি দেখাশুনা, তত্ত্বাবধায়ন করার প্রয়োজন দেখা দিলে
৪। যে কোন বিষয়ে থানা, কোর্ট-কাচারীতে মামলা করার প্রয়োজন দেখা দিলে
৫। স্বামী বা স্ত্রীকে তালাক প্রদানের প্রয়োজন দেখা দিলে
এখন জেনে নেয়া যাক আমমোক্তারনামা বা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি কি?
এটি একটি আইনগত দলিল। স্ট্যাম্প আইন অনুযায়ী যে দলিল দিয়ে কোনো ব্যক্তিকে অপর কোনো ব্যক্তির পক্ষে হাজির হয়ে কাজ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে তাকে আমমোক্তারনামা দলিল বলে। যাকে মোক্তার নিয়োগ করা হয় তিনি মূল মালিকের পক্ষে সম্পত্তির দান, বিক্রি, হস্তান্তর, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্ধক রাখা, খাজনা প্রদান করে থাকেন। তবে আমমোক্তারনামা দলিলে স্পষ্ট করে লেখা থাকতে হবে যাকে পাওয়ার বা ক্ষমতা দেওয়া হলো তিনি কী কী কাজ মালিকের পক্ষে করতে পারবেন, কিংবা পারবেন না।
সাধারণত আম মোক্তারনামা দুই প্রকার। একটি হচ্ছে সাধারণ মোক্তারনামা, যাকে আমমোক্তারনামা বলা হয়। আরেকটি হচ্ছে খাস মোক্তারনামা, যাকে বিশেষ মোক্তারনামা বলা হয়। আমমোক্তারনামায় আমমোক্তারদাতার পক্ষে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয় কিন্তু বিশেষ মোক্তারনামা সম্পাদন করতে হয় নির্দিষ্ট কাজের জন্য। আমমোক্তারনামা যেগুলো জমিজমা হস্তান্তরের সঙ্গে জড়িত নয়, সেগুলো নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে নোটারি করে নিলে হয়। কিন্তু জমিজমা হস্তান্তর সংক্রান্ত মোক্তারনামা অবশ্যই রেজিস্ট্রি করাতে হবে, নইলে এর আইনগত ভিত্তি থাকে না। রেজিস্ট্রেশন, দলিল সম্পাদনের তিন মাসের মধ্যে করতে হবে। ২০১১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তারনামার ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম করা হয়েছে। যেকোনো দলিল হস্তান্তর, ক্রয়, বিক্রয়, উন্নয়ন এবং ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের ছবি দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে বিদেশে বসবাস বা অবস্থানরত কোনো ব্যক্তি কাউকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তারনামা দিতে চাইলে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে দলিল সম্পন্ন করে এবং প্রত্যয়ন করে পাঠাতে হবে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তা সত্যায়িত করাতে হবে।
তবে মনে রাখতে হবে যেকোনো সময় মোক্তারনামা বাতিল করা যায়। যে রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল সে জেলায় রেজিস্ট্রারের বরাবর মোক্তারনামা বাতিলের জন্য আবেদন করতে হবে। রেজিস্ট্রার এটি বাতিল করবেন নির্ধারিত পদ্ধতিতে এবং তার জেলার রেজিস্ট্রি অফিসে নোটিশের মাধ্যমে জানিয়ে দেবেন। যদি রেজিস্ট্রি করা না হয়ে থাকে তাহলে আমমোক্তার বাতিল ঘোষণা করে নির্ধারিত স্ট্যাম্পে দলিল সম্পন্ন করা যেতে পারে। তবে মনে রাখবেন সব পাওয়ার অব অ্যাটর্নি রেজিস্ট্রেশন করতে হয় না, যে পাওয়ারের মাধ্যমে সম্পত্তি বিক্রয়ের অধিকার দেওয়া হয় সেগুলো রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এছাড়া মোক্তারনামা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য করা হলে মেয়াদ শেষে আপনা-আপনিই বাতিল হয়ে যায়। মোক্তারনামা নির্দিষ্ট কোনো কার্যের জন্য করা হলে ওই কাজ সমাপ্তিতে তা বাতিল বলে গণ্য হবে। যৌথ ক্ষমতার মোক্তারনামার পক্ষদের একজনের মৃত্যুতে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮