এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের ব্যাখায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গন্য হবেন।
শাব্দিক অর্থে ধর্ষণ হচ্ছে কোন মহিলা বা বালিকার সাথে তার সম্মতি ছাড়া যৌনকর্ম করা। ধর্ষণের অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে বীর্যপাতের জন্য পূর্ণাঙ্গ লিঙ্গ অনুপ্রবেশ অথবা সতীচ্ছদ ছিন্ন করার আবশ্যক হয় না। নারীর যৌনদ্বার এর উপরাংশে বীর্যপাত করে অথবা না করে লিঙ্গ অনুপ্রবেশ করলে অথবা অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টা করলেই তা নারী ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হয়। অর্থাৎ ধর্ষণের অপরাধের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ কর্মের আবশ্যক হয় না। কৌশলগত অনুপ্রবেশ বা অল্প অনুপ্রবেশ করা হলেও তা যথেষ্ট হিসেবে বিবেচিত হবে বলে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে।
তবে ধর্ষণের অপরাধে কোন পুরুষকে শাস্তি প্রদান করতে হলে কেবলমাত্র নারীর বক্তব্য তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করা হয়েছে এরূপ ভাষা গ্রহণ সঠিক নয়। ওই নারীর বক্তব্য অবশ্য সাক্ষীর মাধ্যমে সমর্থিত হবে। (১৫ ডিএলআর ১৫৫)। তবে প্রাপ্তবয়স্কা মহিলা ধর্ষণের মামলা আদালতকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নিষ্পত্তি করতে হয়। কারণ প্রমাণের জন্য অবশ্য সমর্থনযোগ্য সাক্ষীর উপস্থিতি থাকতে হবে। (১৯ ডিএলআর (এসসি) ২৫৯)। অভিযুক্তের সাথে কথিত ধর্ষিতা প্রাপ্ত বয়স্ক নারী যখন যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত বলে প্রমান পাওয়া যায় এবং উক্ত নারী যৌন সঙ্গমে কোন প্রকার বাঁধা প্রদান করেননি বা বাঁধা প্রদানের চেষ্টাও করেননি অথবা কোন প্রকার চিৎকার দেননি তখন কথিত ধর্ষিতা একজন যৌন সঙ্গমে ইচ্ছুক অংশীদার হওয়ায় তা ধর্ষনের অপরাধ বলে গণ্য হবে না। (৫৭ ডিএলআর ২০০৫, ৫৯১)
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় (যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে) বলেছেন, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে। মোটকথা, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যখন জেনে-বুঝে কোনো শারীরিক সম্পর্কে জড়াবেন তখন পরবর্তীতে সেই সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ হিসেবে আদালতের কাছে প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের দায়ে প্রতারণার মামলা চলতে পারে। তবে ভিকটিম যদি ১৪ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে সেটিকে ‘ধর্ষণ’ বলা হবে। কারণ এই বয়সী মেয়ে সম্মতি দেয়ার মতো সক্ষমতা রাখে না বলে আইন মনে করে।
উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও কেস ষ্টাডি থেকে জানা যায়, কথিত ধর্ষিতা স্বেচ্ছায় নিয়মিতভাবে অ্যাপীলেন্ট আসামীর সাথে যৌন সহবাস করেছে এবং ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারা এবং দণ্ড বিধির ৩৭৫ ধারায় বর্ণিত সংজ্ঞা অনুসারে এটা কোন ধর্ষণের মামলা নয়। রাষ্ট্রপক্ষের উল্লেখিত সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, ধর্ষিতার সাক্ষ্য-১, সাজাপ্রাপ্ত অ্যাপীল্যান্টের সাথে যৌন সহবাসের একজন নিয়মিত ঐচ্ছিক অংশীদার ছিল। ভিকটিম ১৭ বছরের অধিক বয়সের হয়ে নিয়মিতভাবে অ্যাপীলান্টের সাথে যৌন সহবাসে সম্মতি দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের মামলা হল, ভিকটিম সাক্ষী নাঈমা আক্তার তুহিন একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং সে দাবি করেছেন যে, তার এ সন্তান সাজাপ্রাপ্ত আসামী নাজমূল ইসলাম কর্তৃক তার উপর ধর্ষণের ফল। কথিত ঘটনা নিশ্চিত করতে কোন ডিএনএ পরীক্ষা হয়নি এবং ভিকটিমের চাচাত ভাই সাক্ষী ২, ৪, ৬ এবং ১১ তাদের জেরায় বলেন যে, ভিকটিমের সন্তানের পিতা সাজাপ্রাপ্ত আসামী নাজমূল ইসলাম ওরফে নাজু কিনা সে সম্পর্কে তারা কিছু জানেন না। উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, ভিকটিম পিডাব্লিউ-১ স্বেচ্ছায় নিয়মিতভাবে অ্যাপীল্যান্টের সাথে যৌন সহবাস করেছে এবং ২০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারা এবং দ-বিধির ৩৭৫ ধারায় বর্ণিত সংজ্ঞা মোতাবেক এটা কোন ধর্ষণের মামলা নয় (প্যারা-২৮)।
সংশ্লিষ্ট কাজের প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান থেকে সচেতনভাবে সম্মতি দিলেই তা সম্মতি হিসাবে গন্য হয়। মদের প্রভাবে সম্মতি দেয়া হয় অথবা অপ্রকৃতিস্থ মহিলা যে সম্মতি দেয় তা আইনের দৃষ্টিতে কোন সম্মতি হিসাবে গন্য হয় না। (পিএলডি ১৯৫৯ (লাহোর) ৩৮)
কোন বয়স্কা মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ তোলা হলে তাকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে, তার সম্মতি ব্যতীত অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌন সহবাস করা হয়েছে। আসামীকে এটা প্রমাণ করার আবশ্যক নাই যে, উক্ত মহিলার সম্মতি নিয়ে যৌন সহবাস করা হয়েছে। অভিযোগকারী অভিযোগ তুলিল যে, আসামীর হাতে যে ছুরি ছিল তা সম্পর্কে কোন সাক্ষ্য পাওয়া যায় নাই। অথবা আসমীর হাতে যে ছুরি ছিল তা সম্পর্কে অভিযোগপত্রেও কিছু বলা হয় নাই। মেডিকেল সাক্ষ্য দ্বারাও এটা প্রমাণিত হয় নাই যে, অভিযোগকারীর গুপ্তাাঙ্গে কোন জখম আছে কি-না। আসামীর মাথায় জখম ব্যতীত তার অন্য কোথাও কোন জখম ছিল না। অভিযোগকারীর স্বামী এসে পড়ায় আসামী পালাবার সময় উক্ত মাথায় জখম পেয়েছিল। পারিপার্শ্বিক অবস্থা হতে এটা প্রমাণিত হয় যে, অভিযোগকারীর সম্মতি নিয়ে যৌনসহবাস করা হয়েছে।
মেডিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেল, ১০ বৎসরের মেয়ের সতিচ্ছদ ছিন্ন হয়েছে। উক্ত মেয়েটি যৌনসহবাসে অভ্যস্ত ছিল মর্মে ঘটনা কদাচিৎ বিশ্বাসযোগ্য। অপরপক্ষে ডাক্তার মত প্রকশ করেন যে, ধর্ষনের ফলেই উক্ত মেয়ের সতীচ্ছদ ছিন্ন হয়েছে। এক্ষেত্রে বাদীর মামলা সমর্থন করা যায়।(১৯৫৮ সিআরএলজে ১১৪২)।
আংশিক অনুপ্রবেশ যদিও সতীচ্ছদ ছিন্ন করতে যথেষ্ট হিসাবে গণ্য হয় না তবুও তা ৩৭৬ ধারার অধীনে পূর্ণাঙ্গ অনুপ্রবেশ হিসাবে গন্য হয় এবং অপরাধটি ধর্ষণ করার প্রচেষ্টা হিসাবে বিবেচিত না হয়ে ধর্ষণের অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়। (এআইআর ১৯৬২ (ক্যাল) ৬৪১)
লেখকঃ বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com